দেশের রাজনীতিতে ছাত্রদের ভূমিকা

0
1226
blank
blank

এবনে গোলাম সামাদ: রাজনীতি হলো রাজার নীতি। রাজারা করেছেন রাজ্য শাসন। শব্দগত অর্থে রাজনীতি বলতে বোঝায় রাজ্য-শাসননীতি। প্রজারা চেয়েছে রাজার ক্ষমতা কমাতে। প্রজাদের ক্ষেত্রে রাজনীতির অর্থ দাঁড়িয়েছে, রাজার ক্ষমতার সীমাবদ্ধকরণ। আর এক কথায় রাজাকে স্বৈরাচারী হতে না দেয়া। বিলাতে ম্যাগনা কার্টা প্রবর্তিত হয় ১২১৫ সালে। এটাই ইউরোপে প্রথম লিখিতভাবে রাজার ক্ষমতা কমানোর দলিল। বাংলা ভাষায় রাজা শব্দটা এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে। রাজা শব্দটার অর্থ হলো শ্রেষ্ঠ মানুষ। অনেকে মনে করেন শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে প্রজারা কাউকে বেছে নিয়ে করতেন রাজা। রাজার ছেলেই যে রাজা হতো, তা নয়। পরে রাজতন্ত্র হয়ে দাঁড়ায় বংশানুক্রমিক। রাজারা হয়ে উঠতে চান স্বেচ্ছাচারী। প্রজারা চায় রাজার স্বেচ্ছাচার কমাতে। রাজনীতির সাথে জড়িয়ে আছে রাজা-প্রজার মধ্যে সৃষ্ট বিরোধ। রাজনীতির একটা লক্ষ্য হয়েছে এই বিরোধের মাত্রা কমানো। এর ফলে এসেছে আধুনিক গণতন্ত্রের ধারণা। আর তার হাত ধরেই এসেছে ভোটের রাজনীতি। বিলাতে প্রথম স্বেচ্ছাচারী রাজার মাথা কাটা যায়। কিন্তু বিলাতে আবার রাজতন্ত্র ফিরে আসে। বিলাত হয়ে ওঠে যাকে বলে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র। ফরাসি দেশে রাজারা ভেবেছে, রাজাই হলো রাষ্ট্র। তারা যা করবে প্রজাদের তাই নিতে হবে মেনে। ফরাসি দেশে প্রজারা করেছে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। মাথা কাটা গেছে রাজার। বিদ্রোহীরা ঘোষণা করেছে স্বাধীনতা, সমতা ও ভাতৃত্বের বাণী। ফ্রান্সে প্রথম লিখিতভাবে ঘোষিত হয় মানবাধিকার, যা সারা ইউরোপের চিন্তাচেতনাকে প্রভাবিত করে। ইউরোপে আরেকটি ধারণা রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। যেটা হলো জাতীয়তাবাদ, অর্থাৎ ইউরোপে রাজনীতির ক্ষেত্রে তিনটি ধারণা প্রাধান্য পায়। এরা হলো : জাতীয়তাবাদ, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র। ব্রিটিশ শাসনামলে পাশ্চাত্যের এই তিনটি ধারণা এসে পৌঁছায় আমাদের কাছে পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে। ছাত্ররা এসব ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে করতে চায় রাজনীতি। অর্থাৎ এ দেশে এসব ধারণার বাস্তবায়ন। এ দেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তনের আগে রাজনীতি ছিল না। ছাত্র রাজনীতিও ছিল না। বিলাতে যখন হচ্ছে ম্যাগনা কার্টার প্রবর্তন, তখন এ দেশের একটা অংশজুড়ে চলেছে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির রাজত্ব। প্রজারা ভাবেনি যে, বিন বখতিয়ার শাসনক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো প্রয়োজন আছে। তারা মেনে নিয়েছে বিন বখতিয়ারের শাসন। বাংলাভাষী হিন্দু ছাত্ররা প্রথম গ্রহণ করতে শুরু করে পাশ্চাত্য শিক্ষা। তাদের মধ্যেই প্রথম শুরু হয় ছাত্ররাজনীতি। মুসলমানেরা ইউরোপীয় সভ্যতাকে মনে করত ফিরিঙ্গি সভ্যতা। মুসলিম বিশ্বের সাথে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের ধর্মযুদ্ধ চলেছে প্রায় দুই শ’ বছর ধরে জেরুসালেমের অধিকার নিয়ে। ধর্মযুদ্ধের সময় ইউরোপীয় সভ্যতা থেকে মুসলিম বিশ্বের সভ্যতা ছিল অনেক উন্নত। মুসলমানের কাছে তাই মনে হয়নি ইউরোপীয় সভ্যতাকে গ্রহণযোগ্য বলে। একটা বিশেষ অহঙ্কার কাজ করেছে তাদের মধ্যে।
পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে হিন্দু ছাত্ররা পাচ্ছিলেন বিদ্রোহের চেতনা। ব্রিটিশ প্রশাসন এটা উপলদ্ধি করতে পেরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমন্ড বার্কের লেখা বিখ্যাত French Revolution বইটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ ছাত্রদের পাঠ্যতালিকা থেকে বাদ দেন ১৯০১ সালে। এরপর তারা স্কুলের ছাত্রদের পাঠ্যতালিকা থেকে বাদ দেন ব্রিটেনের ইতিহাস পড়ানো। কারণ, তারা মনে করেন যে, ব্রিটেনের ইতিহাস পড়ে এ দেশের ছাত্রদের মনে জাগরিত হচ্ছে জাতীয়তাবোধ। ছাত্ররাজনীতি শুরু হয় কলকাতা শহরে, যা ছিল ১৯১২ সাল পর্যন্ত সারা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। ছাত্ররাজনীতির প্রধান লক্ষ্য হয় এ দেশ থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান। হিন্দু ছাত্রদের এক অংশ গঠন করে সন্ত্রাসবাদী দল। তাদের লক্ষ্য হয় উচ্চ ব্রিটিশ সরকারি কর্মচারীদের মেরে ফেলে ত্রাস সৃষ্টি করা। তারা মনে করে, এরকম ত্রাস সৃষ্টি করতে পারলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটবে। সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মুজাফফর আহমদ তার ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন- “বাঙলায় সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের অদ্ভ্যুদয় একটি স্মরণীয় ঘটনা। এটা ছিল একটি গোপন আন্দোলন। বঙ্গভঙ্গের আগেই তাদের দল গড়ে উঠেছিল। অবশ্য বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন তাঁদের বিশেষ প্রেরণা জুগিয়েছিল। এটা বিশেষ লক্ষণীয় যে, বাঙলা দেশেই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বিশেষ দানা বেঁধে উঠেছিল। বাঙলার শিক্ষিত ‘ভদ্রলোক’ সম্প্রদায়ের ভেতরেই ছিল তার উর্বর ক্ষেত্র। বাঙলার বাহিরেও সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের কর্মপ্রচেষ্টা চলেছে। কিন্তু বাঙলার মত দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।… বাঙলাদেশের সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলন নিঃসন্দেহে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছিল। কিন্তু তা হিন্দু উত্থানের আন্দোলনও ছিল। উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু রাজত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা।… ঊনিশ শ’ বিশের দশকে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের মধ্যে ধারণার পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। তবুও আমি ১৯২৩-২৪ সালে তাদের একজন বড় নেতাকে দেখেছি যে, বিকেলে তিনি জেলে এলেন তার পরের সকালেই জেল অফিসে একটি সম্ভ্রমাকর্ষক কালীর ছবির জন্য (an imposing picture of Goddess Kali) অর্ডার পাঠালেন।” অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন কেবল যে ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার আন্দোলন ছিল, তা নয়। এই আন্দোলন ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদভিত্তিক। এর লক্ষ্য ছিল হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। সন্ত্রাসবাদীরা কোনো মুসলমানকে তাদের দলে গ্রহণ করত না। কেবল তাই নয়, সন্ত্রাসবাদীরা কোনো নিম্নবর্ণের হিন্দুকেও গ্রহণ করত না তাদের দলে। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সূর্যসেনের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবাদীরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে। এবং চট্টগ্রামকে প্রায় এক সপ্তাহ দখল করে রাখে। কিন্তু পরে তা আবার চলে যায় ব্রিটিশ প্রশাসনেরই হাতে। সূর্যসেন তার দলে কোনো মুসলমানকে গ্রহণ করতেন না। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পর তার দলের বীরকন্যা প্রীতিলতার নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে করা হয়েছে একটি ছাত্রীনিবাস। বোঝাবার চেষ্টা হচ্ছে সূর্যসেন ও তার দলের ব্যক্তিরা ছিলেন খাঁটি বাঙালি। সূর্যসেনের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ হওয়ার পরে ছাত্রাবাস গড়া হয়েছে। কিন্তু এসব গড়া হয়েছে ইতিহাসকে বিকৃত করেই। আমাদের আজকের বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের সাথে সূর্যসেনের জাতীয়তাবাদের কোনো সুদূর যোগাযোগ নেই। কেননা, আজকের বাংলাদেশের সীমানা রচিত হয়েছে পাকিস্তান আন্দোলনের ফলে। এর মধ্যে কাজ করেছে মুসলিম জাতীয়তাবাদ। যার চরিত্র হলো ভিন্ন। বাংলাদেশে এবং সারা উপমহাদেশে মুসলিম জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয় হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। হিন্দুরা মুসলমানকে ভেবেছে ম্লেচ্ছ, অশূচি। তাদের ছোঁয়ায় নষ্ট হয়েছে তাদের জাতিত্ব। বিখ্যাত আরব মুসলিম পরিব্রাজক ইবনে বতুতা খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মরক্কো থেকে এসেছিলেন এ উপমহাদেশে। তিনি বাংলাদেশেও এসেছিলেন। তিনি তার ভূবনবৃত্তান্তে লিখেছেন ‘তৃষ্ণার্ত মুসলমান পথিক পানি পান করতে চাইলে হিন্দুরা তা দেয় না। কেননা, তারা মনে করে এর ফলে তাদের পানপাত্র অপবিত্র হবে।’ কেন এই উপমহাদেশে পাকিস্তান আন্দোলন হয়েছিল তার ইতিহাসকে বুঝতে হলে মনে রাখতে হবে হিন্দু মুসলমান বিরোধের এই সামাজিক পটভূমি। হিন্দুদের পক্ষ থেকে মুসলমানকে অস্পৃশ্য ভাবা। হিন্দুরা মুসলমানকে তাদের চেয়ে হীন না ভাবলে সৃষ্টি হতো না হিন্দু-মুসলমান বৈরিতা। উদ্ভব হতে পারত না পৃথক মুসলিম জাতীয়তাবাদের।
অনেকে বলে মুসলমানেরা হলো ধর্মান্ধ। কিন্তু এ দেশে হিন্দুরাও রাজনীতিতে ধর্মকে জড়িয়ে ফেলেছে নানাভাবে। হিন্দু ছাত্ররা ভেবেছে মা কালীর পূজা করলে তারা পেতে পারবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে আত্মিক শক্তি। হিন্দু ছেলেরা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে কিন্তু তাদের মন থেকে প্রাচীন হিন্দু বিশ্বাস তা বলে দূর হয়নি। তারা মা কালীর পূজা করেছে ব্রিটিশ শাসন অবসানের লড়াইয়ে মানসিক শক্তি লাভের লক্ষ্যে।
পাকিস্তান আন্দোলনে যেসব নেতা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা সবাই ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত। অনেকেই ছিলেন বিলাত ফেরত। পাকিস্তান নামটি যিনি চয়ন করেন, সেই চৌধুরী রহমত আলী ছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি নামটা চয়ন করেন ১৯৩৩ সালে। তিনি ছিলেন পাঞ্জাবি মুসলমান। পরে তিনি বাংলাদেশকে গ্রহণ করেন তার পাকিস্তান পরিকল্পনায়। তিনি বাংলাদেশকে বলেন ‘বাঙ্গে-ইসলাম’। অর্থাৎ তার পরিকল্পনায় তখনকার বাংলা প্রদেশকে পাকিস্তানে গ্রহণ করা হয় তখনকার বাংলার বিশেষ স্বাতন্ত্র্যকে মেনে। তিনি ঠিক এককেন্দ্রিক পাকিস্তান রাষ্ট্র চেয়েছিলেন, তা নয়। তার ধারণা বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তান হবে একটি রাষ্ট্র সমবায় বা কনফেডারেশন। কেননা, এর মধ্যে থাকবে বিরাট ভৌগোলিক ব্যবধান। ব্রিটিশ বাংলায় মুসলমান ছাত্ররা পাকিস্তান আন্দোলন করেছিল। এর প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতায় অবস্থিত ইসলামিয়া কলেজ। যার প্রিন্সিপাল ছিলেন ডক্টর আই এইচ জুবেরী। যিনি তার ডক্টরেট ডিগ্রি করেছিলেন ইংরেজি সাহিত্যে, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ইনি ছিলেন বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের লোক। কিন্তু তার কর্মজীবন কেটেছে প্রধানত কলকাতা শহরে। পরে তিনি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। আসলে তার উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি যখন রাজশাহী কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন, পাকিস্তান হওয়ার পর তখন গ্রহণ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। শেখ মুজিব ছিলেন জুবেরীর খুব প্রিয় ছাত্র। ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র থাকার সময় শেখ মুজিব পাকিস্তান আন্দোলনে গ্রহণ করেন বিশেষ ভূমিকা। তার নিজের কথায়- ‘তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নেই। শুধু মুসলিম লীগ, আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী। পৃষ্ঠা-১৫। দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা ২০১২ খ্রি)। এখন অনেকের লেখা পড়লে মনে হয় যেন বর্তমান পাকিস্তানে হয়েছিল পাকিস্তান আন্দোলন। বাংলাভাষী মুসলমান এতে শরিক ছিলেন না। কিন্তু বাংলাভাষী মুসলমান পাকিস্তান আন্দোলন করেছিলেন বলেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। এটা ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৪০ সালে লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাব পাস হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত নেতা এ কে ফজলুল হক, পাঞ্জাবের কোনো মুসলিম নেতা নন। বাংলা প্রদেশের একটা বিশেষ বিবেচ্য ছিল বলেই ফজলুল হককে দিয়ে পাকিস্তান প্রস্তাব তোলা হয়। নচেৎ হতো না।
ইতিহাসের অনেক কিছুকেই এখন ঢেলে সাজানোর চেষ্টা হচ্ছে। যেমন বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগ বরাবরই ছিল একটা বাঙালি জাতীয়তাবাদী দল। কিন্তু আওয়ামী লীগের ইতিহাস তা বলে না। আওয়ামী লীগ নিজেকে দাবি করেছে একটা নিখিল পাকিস্তান দল হিসেবে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কেবল পূর্বপাকিস্তান থেকেই এমএনএ প্রার্থী দাঁড় করেনি। সে সময় পাকিস্তানে ছিল পাঁচটি প্রদেশ। পাকিস্তানের তিনটি প্রদেশ থেকে আওয়ামী লীগ এমএনএ প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। যদিও একমাত্র পূর্বপাকিস্তান ছাড়া সাবেক পাকিস্তানের আর কোনো প্রদেশ থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি। অন্য দিকে, পাকিস্তানের পিপলস পার্টি পূর্বপাকিস্তান থেকে কোনো প্রার্থী দাঁড় করায়নি। সে কেবল প্রার্থী দিয়েছিল তদানীন্তন পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ ও এক উপজাতি অঞ্চল থেকে। অর্থাৎ পিপিপি ছিল কেবলই তদানীন্তন পাকিস্তানের পশ্চিম ভাগের একটি দল, সারা পাকিস্তানের দল সে ছিল না। আওয়ামী লীগ ১৯৭০-এর নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল প্রেসিডেন্ট আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার Legal Framework Order, ১৯৭০ অনুসারে। যাতে বলা হয়েছিল, পাকিস্তান হবে একটি যুক্তরাষ্ট্র বা ফেডারেশন। এতে ছিল না কোনো রাষ্ট্র সমবায় বা কনফেডারেশন গড়ার কোনো সুযোগ। শেখ মুজিব ঠিক কী চেয়েছিলেন সেটা অনেকের কাছেই খুব স্বচ্ছ নয়। কেননা, তিনি তার ৭ মার্চের বিখ্যাত বক্তৃতায় দাবি করেছিলেন যে, তিনি সারা পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা। কেবলমাত্র পূর্বপাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা নন। এ থেকে ধারণা করা যায় যে, তিনি চেয়েছিলেন তদানীন্তন সারা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে। না হলে তিনি কখনোই বলতেন না যে, তিনি হলেন সারা পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা।
লেখক: প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট