নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ

0
869
blank
blank

ইকতেদার আহমেদ: নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপ্রতি পদের নির্বাচন অনুষ্ঠান, সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান, সংসদে নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ এবং রাষ্ট্রপতির পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। উপরোল্লিখিত দায়িত্ব ছাড়াও সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে অন্য কোনো আইনের অধীনে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনবিষয়ক অপর যেসব দায়িত্ব দেয়া হবে, নির্বাচন কমিশন সেসব দায়িত্বও পালন করবেন।

স্থানীয় সরকারব্যবস্থার অধীন যেসব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন ‘নির্বাচন কমিশন’ পরিচালনা করে সে সংস্থাগুলো হলো সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদ। সংসদের নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন যে ভোটার তালিকা প্রস্তুত করে তা ভোটার তালিকার ভিত্তিতেই নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকারব্যবস্থার অধীন প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন পরিচালনা করে, যদিও স্থানীয় সরকারের অধীন প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনের সীমানা নির্ধারণের কাজটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যত্যয়ে নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সমাধা করে।
সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করা হলেও নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ বিষয়ে আইনের মাধ্যমে আজ পর্যন্ত কোনো যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। বর্তমানে নির্বাচন কমিশন একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনার সমন্বয়ে গঠিত। এদের সবাইকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন।

বর্তমানে যে নির্বাচন কমিশনটি কর্মরত রয়েছে, এটি দ্বাদশ নির্বাচন কমিশন। একাদশ নির্বাচন কমিশন গঠনের সময় যে প্রক্রিয়া অনুসৃত হয়েছিল এ নির্বাচনটি গঠনেও সমপ্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে। বাছাই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচন কমিশনের গঠন প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছতা দেয়ার প্রয়াস নেয়া হলেও উভয় কমিশনে যেসব ব্যক্তির ঠাঁই মিলেছে এরা কেউই সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিজেদের অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম হিসেবে প্রতিষ্ঠায় সফলতা দেখাতে পারেননি।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের জন্য গত ১৫ মে, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান করতে পারলে এ নির্বাচন কমিশনের পক্ষে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান সম্ভব হবে এমন আস্থা সৃষ্টির ক্ষেত্র প্রস্তুতে সহায়ক হতো।

জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকারব্যবস্থার অধীন প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থীর জন্য সমসুযোগ সম্বলিত মাঠের ব্যবস্থা করতে হয়। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থীর সমর্থনে দলীয় নেতাকর্মীরা নির্বিঘেœ নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত পুলিশের বাঁধার মুখোমুখি হয়ে অনেকে আটকের কবলে পড়েছেন আবার অনেকে আটক এড়াতে প্রচারণা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আটক অথবা পুরাতন মামলায় আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে আটক বিষয়ে বিধিনিষেধ থাকলেও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতাকর্মীরা এ সুযোগের আওতায় থেকে যে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেননি তা নির্বাচন পূর্ববর্তী বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে স্থান পেয়েছে। এ বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের পক্ষ হতে একাধিকবার অবহিত করা হলেও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি।

নির্বাচন কমিশনের অধীন অনুষ্ঠিত যেকোনো নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচনের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রিটার্নিং অফিসারের ওপর ন্যস্ত করা হয়। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা গেল ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষাবলম্বনে দলটির একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনের সাথে সাক্ষাৎ করে রিটার্নিং অফিসার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থীর প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট এমন অভিযোগ উত্থাপন করে সমসুযোগ সম্বলিত মাঠের অনুপস্থিতির দাবি তুলেছেন। ক্ষমতাসীন দলের এ দাবিকে তাৎক্ষণিক আমলে নিয়ে দেখা গেল নির্বাচন কমিশন যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে রিটার্নিং অফিসারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে সেখানে পাঠানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। বাংলাদেশে এর আগে কোনো নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যায়নি। এরূপ ঘটনা যে একজন রিটার্নিং অফিসারের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালনের অন্তরায় এ বিষয়টি নির্বাচন সংশ্লিষ্ট এ দেশের সচেতন জনমানুষ উপলব্ধি করতে পারলেও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে এরূপ উপলব্ধির ঘাটতি বিরাজমান।

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষ থেকে নির্বাচনী প্রচারণা চালনাকালীন ভোটারদের পুনঃপুনঃ স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় অতীতে তাকে নির্বাচিত না করার কারণে খুলনা সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কার্যক্রম যে ব্যাহত হয়েছে, এবারো যদি তাকে নির্বাচিত করা না হয় সে ধারা অব্যাহত থাকবে। আমাদের দেশের জন্য এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক- অতীতে খুলনা সিটি করপোরেশনসহ অপর যে চারটি সিটি করপোরেশনে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যে দলের প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের সবাইকেই ফৌজদারি মামলায় বিজড়নে সাময়িক বরখাস্ত ও কারাভোগের মধ্যে পড়তে হয়েছিল। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধি এ ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণের মুখোমুখি হলে তা এ দেশে গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বড় ধরনের অশনি সঙ্কেত। তা ছাড়া ক্ষমতাসীন দলবহির্ভূত অপর কোনো দলের প্রার্থী জনআকাক্সক্ষায় নির্বাচিত হলে সে এলাকা সরকারের উন্নয়ন বরাদ্দ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে এটি অপশাসনের বার্তা দেয়।

যেকোনো নির্বাচনে ভোটগ্রহণ চলাকালীন একজন প্রার্থী তার ক’জন সহকর্মীসমেত ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবেন তা আইন ও বিধি দিয়ে নির্ধারিত। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়Ñ ক্ষমতাসীন দলের সমর্থিত প্রার্থী প্রতিটি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনের সময় তার সাথে তার দলীয় ২০-২৫ জন নেতাকর্মী ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করেন এবং তার প্রস্থান পরবর্তী তারা ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরে প্রভাব খাটিয়ে ব্যালট পেপারে জোরপূর্বক সিল মেরে ভোটবাক্স পূর্ণ করেন। তাদের এহেন অবৈধ ও অন্যায় কাজে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনরত কর্মকর্তাদের অসহায় পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়।

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট অনুষ্ঠানের দিন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থীর নির্বাচনী অ্যাজেন্টদের বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রের ভোটকক্ষে অনুপস্থিত দেখা গেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশ্বস্ত সংবাদ নিশ্চিত করেছে এদের অনেকে পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারদের হুমকির কারণে ভোটকক্ষে উপস্থিত হননি। আবার অনেকে ভোটকক্ষে উপস্থিত হওয়া পরবর্তী হয়রানি ও নাজেহালের শিকার হয়ে কক্ষ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। এ বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করা হলেও কমিশনের পক্ষ থেকে তা নিরসনে কার্যকর কিছুই করা হয়নি।
খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ভোটগ্রহণের দিন দুপুরের পর বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্র ভোটারশূন্য ছিল। এমন পরিস্থিতি শতকরা ৬০ ভাগ ভোটারের উপস্থিতির পরিপন্থী হলেও বাস্তবতা হলো নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা-পরবর্তী দেখা গেল উক্ত সংখ্যক ভোটারের ভোটদানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী বিপুল ভোটের ব্যবধানে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থীকে পরাভূত করেছেন। ফলাফলের এ চিত্রটি যে বাস্তব অবস্থার বিপরীত তা নির্বাচনী এলাকার সচেতন জনমানুষসহ এ দেশের সচেতন জনমানুষ অনুধাবন করতে পারলেও তা আজ মূল্যহীন।

আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকার কর্তৃক যেসব নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে এগুলো গঠনকালীন ক্ষমতাসীনদের বিবেচ্য ছিল এরা তাদের মতাদর্শী কি না এবং এদের দিয়ে তাদের আকাক্সক্ষা চরিতার্থ হবে কি না। এ ধরনের একটি ছাড়া সব নির্বাচন কমিশনই ক্ষমতাসীনদের নিরাশ করেনি। যে নির্বাচন কমিশনটির পক্ষে নিরাশের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছিল সেটি নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীন ক্ষমতাসীনদের পরিবর্তে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত দ্বিতীয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন ছিল।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা ও সামর্থ্য বিষয়ে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন যে একটি অগ্নিপরীক্ষা ছিল তা অনস্বীকার্য। সে অগ্নিপরীক্ষায় নির্বাচন কমিশন যে ব্যর্থ হয়েছে তা সচেতন দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট প্রতিভাত। নির্বাচনের সার্বিক চিত্র পর্যবেক্ষণ-পরবর্তী প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের মন্তব্য থেকে জানা যায়, তারা নির্বাচনটিতে অনিয়ম ও কারচুপি সংঘটিত হওয়ায় খুবই হতাশ। এ বাস্তবতায় ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল এবং আন্তর্জাতিক মহলে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা ও সামর্থ্য বিষয়ে প্রশ্নের উদয় হওয়ায় এ কমিশনটি যে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণভাবে আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অক্ষম এ আলোচনাটির বিশ্বাসের ভিত আজ দৃঢ়তর।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com