পুষ্টি নিশ্চিত করতে মাছ উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই: প্রধানমন্ত্রী

0
499
blank

বিশেষ সংবাদদাতা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যার ক্ষতি পোষাতে মৎস্য চাষে গুরুত্ব দিতে হবে। মাছ সবচেয়ে নিরাপদ খাদ্য। এজন্য এই সম্পদ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ আরো বাড়াতে হবে। জনগণের পুষ্টি নিশ্চিত করতে মাছ উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। বর্তমান সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণেই ইলিশ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। বুধবার সকালে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মোহাম্মদ ছায়েদুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায় চন্দ্র চন্দ। মৎস্য সচিব মাকসুদুল হাসান খান উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন।
মাছ চাষে গড়বো দেশ, বদলে দেব বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যে ১৮ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপী মৎস্য সপ্তাহ পালিত হবে। মৎস্য সপ্তাহ যথাযথভাবে পালনের জন্য মন্ত্রণালয় ও মৎস্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে দেশে মাছ চাষের উন্নয়নের ওপর একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এছাড়া মৎস্য খাতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ১৩টি পুরস্কার দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের স্বর্ণ ও রৌপ্য মেডেল পরিয়ে দেন।
উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশে শুধু মাছ চাষ বাড়ালেই চলবে না, মাছ সংরক্ষণ ও রফতানি করার উপযোগী করে তুলতে হবে। মাছ রফতানি বাড়াতে সিলেট ও উত্তরাঞ্চলে দুটি ল্যাব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
ধানমন্ত্রী বলেন, মাছ ক্লোলেস্টেরোল ফ্রি। এর তেল আরও উপকারী। এ কারণে মাছ বেশি খেলে অসুবিধা হয় না। বাংলাদেশের মাটি সোনার মাটি। এখানে ফসল যেমন উৎপাদন হয়, তেমনি মাছ চাষের জন্যও উপযোগী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিঠাপানির মাছ চাষে আমরা বিশ্বে চতুর্থ স্থানে। আগামীতে মৎস্য চাষে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তাতে আমাদের দেশ মৎস্য উৎপাদনে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণভবনের লেকে মৎস্য পোনা অবমুক্ত করে এই মৎস্য সপ্তাহের উদ্বোধন করেন। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা প্রতি বছর এই মৎস্য সপ্তাহ পালন করি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের এখানে ভেজাল দেয়ার একটা প্রবণতা আছে, এই ভেজাল দেয়ার দরকারটা কী? এই ভেজাল দিয়ে বেশি মুনাফা করতে গিয়ে নিজের ব্যবসারও সর্বনাশ, দেশেরও সর্বনাশ হচ্ছে। এতে দেশেরও সুনাম নষ্ট হয়। বিদেশেও দেশের বাজারের ক্ষতি হয়। এই সর্বনাশের পথে যেন কেউ না যায়। বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাত এবং চাষের সাথে যারা জড়িত, তাদেরকে আমি অনুরোধ করবো, ব্যবসাটাও নষ্ট করবেন না, আর দেশের পণ্যটাও আপনারা নষ্ট করবেন না। চিংড়িতে ভেজাল দেয়ার চেষ্টায় ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৯৬ সালে যখন আমি সরকারে আসি, দেখলাম, চিংড়ি রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। ইউরোপ আমাদের কাছ থেকে আর চিংড়ি নেবে না। তখন এক ভদ্রলোক ছিলেন, তিনি ভাল রাজনৈতিক নেতাও হয়ে গিয়েছিলেন। এক সময় আমাদের পার্টি, আরেক সময় আরেক পার্টি, এভাবে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি চিংড়ি মাছের ভেতর লোহা ঢুকিয়ে দিয়ে ওজন বৃদ্ধি করে রপ্তানি করতে যাচ্ছিলেন। সেটা যখনই ধরা পড়ে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে চিংড়ি রপ্তানি বন্ধ। আমরা কেবলই তখন সরকারে এসেছি। তখন আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কথা বলি। বিষয়্িট তাদের বোঝাতে সক্ষম হই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাছের ক্ষেত্রগুলো, অর্থাৎ মাছের হ্যাচারিগুলো খুব অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল। সে সময় ৪০ কোটি টাকা তাদেরকে আমরা দেই। সে সময় এটা বিশাল একটা অংক। টাকা দিয়ে কমিটি করে দেই যাতে হ্যাচারিগুলো উন্নত মানের হয়। আমাদের রপ্তানি আরও খুলে যায়। রপ্তানির সময় অবশ্যই আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে, যে কোনো মতে কোনো রকম অভিযোগ যেন না আসে। সততার সঙ্গে ব্যবসা করেই মুনাফা অর্জন সম্ভব।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দেশেও বাজার বাড়ছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়ছে। একজন রিকশাওয়ালা আগে যে কামাই করতো, তাতে চালই কেবল কিনতে পারত, এখন আল্লাহর রহমতে তা আর নেই। এখন মাছ থেকে শুরু করে সবই কিনতে পারে, সেই সক্ষমতাটা তাদের আছে। দিনমজুরেরও সেই সক্ষমতাটা বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই চাহিদাটাও বাড়ছে। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ক্রয়ক্ষমতা যত বাড়বে, আমাদের নিজস্ব বাজারও তত সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে দারিদ্র্যের হার কমে গেছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে, মানুষ ভালো জিনিস খেতে চায়, তাদের খাদ্যের চাহিদাটা আমরা দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে করতে পারি।
শেখ হাসিন বলেন, এক সময় ফরমালিক সম্পর্কে সবাই খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। আমরা কিন্তু ফরমালিন এর অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করেছি। মাছে ফরমালিন দেয়ার প্রবণতা অনেকটাই কমে এসেছে। এ বিষয়ে আরও কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, ইলিশ রক্ষায় নানা চেষ্টার ফলে উৎপাদন বছরে এক লাখ টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে তিন লাখ ৮৭ হাজার টনে পৌঁছেছে। ইলিশ রক্ষায় বৈশাখে এই মাছটি না খাওয়ার জন্য আবারো আহ্বান জানান তিনি।
চিংড়ি ও মৎস্য এবং মৎস্যজাত দ্রব্য রপ্তানিতে সরকার উপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাভার, চট্টগ্রাম এবং খুলনায় তিনটি সর্বাধুনিক মান নিয়ন্ত্রণ ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাছাড়া চাষিদের রোগমুক্ত চিংড়ি পোনা সরবরাহের জন্য কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, খুলনায় তিনটি ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কক্সবাজারে আরও একটি ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।
উত্তরবঙ্গেও ভাল মাছ উৎপন্ন হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী সেখানেও পরীক্ষার জন্য একটি এবং সিলেট অঞ্চলে আরও একটি টেস্টিং ল্যাব তৈরি করতে মন্ত্রণালয়কে তাগাদা দেন। সেই সঙ্গে বৃহত্তর সিলেট, বিশেষ করে কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণার হাওর অঞ্চলে মাছ চাষ বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, হাওর অঞ্চলে আমরা যে ফসল ফলাতে যাই, প্রায়ই তো আগাম বন্যা হয় এবং ফসল নষ্ট হয়। মোট কথা, হাওর অঞ্চলগুলোতে আমাদের আসলে মৎস্য চাষের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। ভেতরে যে খাদগুলো আছে, সেগুলো আমাদের কাটতে হবে, ড্রেজিং করতে হবে। কেবল মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি নয়, সেগুলো সংরক্ষণ করা এবং প্রক্রিয়াজাত করাও দরকার। আর এই মাছ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ইংল্যান্ড, ইতালিতে পাঠানো সম্ভব। তিনি বলেন, ইংল্যান্ডে মাছ এবং ভাত খুবই জনপ্রিয়, বিদেশিদের কাছেও জনপ্রিয়। তারা সপ্তাহে একদিন যদি ভাত ও তরকারি না খায়, তাহলে তাদের পেট ভরে না। যেসব মাছের চাহিদা বেশি, সেগুলো নিয়ে গবেষণারও তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহাশোল মাছও এক সময় কেবল পাহাড়ি অঞ্চলে পাওয়া যেত। সেটাও আমরা গবেষণা করে উৎপাদন করছি। সিলেটের মানুষ বোয়াল মাছ খেতে খুব পছন্দ করে। এটার ওপর কোনো গবেষণা এখনও হয়নি। এটার ওপরও গবেষণা দরকার। কোনটার বাজারে চাহিদা বেশি, সেটার ওপর গবেষণা করা, উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানি করা। এটার ওপর আমাদের জোর দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক ধরনের মাছ কিন্তু আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। দেশীয় মাছগুলো, যেগুলো বিপন্ন প্রায় সেগুলো সংগ্রহ করা এবং প্রজনন করে বংশ বিস্তারের জন্য আপনারা দৃষ্টি দেবেন। আশা করি, মাছে, ভাতে বাঙালি-এটা যেন আমরা বজায় রাখতে পারি, সে জন্য তিনি আরও কাজ করতে মৎস্য বিভাগের বিজ্ঞানী ও কর্মীদের প্রতি অনুরোধ জানান।