বছরজুড়ে আলোচনায় বিচার বিভাগ

0
562
blank
blank

ডেস্ক রিপোরট: প্রায় পুরো বছরই নানা ইস্যুতে বিচার বিভাগ ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগের ঘটনা লম্বা সময় ধরে ঘুরেফিরে আলোচনায় এসেছে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ও সবার মনোযোগ ধরে রেখেছিল অনেক দিন। অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশ নিয়ে নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে এক ধরনের টানাপোড়েন চলে লম্বা সময়। এছাড়া বেশ কিছু আলোচিত রায়কে কেন্দ্র করেও বিচার বিভাগ বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল। এর মধ্যে চাঞ্চল্যকর পিলখানা হত্যা মামলা অন্যতম। এ মামলায় ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলা, বিশ্বজিৎ হত্যার আপিলের রায় নিয়েও ঘুরেফিরেই সরব ছিল সুপ্রিমকোর্ট। এছাড়া সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার বিষয়টিও সবার নজর কেড়েছে।

২০১৭ সালে ৬ মাসের বেশি সময় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের বিষয়টি সবার মনোযোগ ধরে রেখেছিল। ৩ জুলাই সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনীর বাতিলে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পায় ১ আগস্ট। রায় ঘোষণার প্রায় ৬ মাস পর ২৪ ডিসেম্বর ষোড়শ সংশোধনীর বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে ৯০৮ পৃষ্ঠার রিভিউ দায়ের করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ রিভিউতে ৯৪টি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের আগে থেকেই শুরু হয়েছে অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালার বিষয়। এ ইস্যুতে বিচার বিভাগ-নির্বাহী বিভাগের মধ্যে টনাপোড়েন স্পষ্ট হয়ে উঠে। এ ধরনের কিছু ইস্যুতেই সরকারের সঙ্গে এসকে সিনহার দূরত্ব তৈরি হয়। প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের মধ্য দিয়ে এর অবসান ঘটে। তবে ওই শূন্য পদে এখনও কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করছেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে প্রধান বিচারপতির অনুরূপ কার্যভার ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি পালন করতে পারবেন। সংবিধান সে ক্ষমতা তাকে দিয়েছে।

এছাড়া বিচারকের নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ ও অপসারণ সংক্রান্ত শৃঙ্খলা বিধিমালা না করায় এক বছর ধরে সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের টানাপোড়েন চলে। অবশেষে ১১ ডিসেম্বর গেজেট প্রকাশ করে সরকার।

এসকে সিনহার বিদায় : ২০১৭ সালে বিচারাঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত ২১ জন বিচারকের মধ্যে সুরেন্দ্র কুমার সিনহাই প্রথম পদত্যাগ করেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে সর্বসম্মতিক্রমে চূড়ান্ত রায়টি দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ। ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। এ রায় নিয়ে তোপের মুখে থাকা এসকে সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশে যান। ১৩ অক্টোবর বিদেশ যাওয়ার সময় একটি লিখিত বিবৃতি তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের হস্তান্তর করেন। সিনহা গণমাধ্যমের সামনে বলেন, ‘আমি অসুস্থ না। আমি পালিয়েও যাচ্ছি না। আমি আবার ফিরে আসব। আমি একটু বিব্রত। আমি বিচার বিভাগের অভিভাবক। বিচার বিভাগের স্বার্থে, বিচার বিভাগ যাতে কলুষিত না হয়, এ কারণেই আমি সাময়িকভাবে যাচ্ছি। আমার কারও প্রতি কোনো বিরাগ নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সরকারকে ভুল বোঝানো হয়েছে। এই আমার বক্তব্য। আর কিছু বলব না। বিদেশ যাওয়ার ২৮ দিনের মাথায় সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ১০ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন। পরে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি।

এদিকে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ উঠে। ৩০ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বঙ্গভবনে ডেকে এসকে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির দালিলিক প্রমাণাদি হস্তান্তর করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার সৈয়দ আমিনুল ইসলামের স্বাক্ষর করা দুই পৃষ্ঠার বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা ফিরে এসে দায়িত্ব গ্রহণ সুদূরপরাহত। কারণ, আপিল বিভাগের বিচারপতিরা তার সঙ্গে এক বেঞ্চে বসতে চান না। অন্য বিচাপতিরা না বসলে এসকে সিনহা একা বিচার কাজ করতে পারবেন না।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল : উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। অ্যাডভোকেট মনজিল মোরেসদসহ নয় আইনজীবীর রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৬ সালের ৫ মে সংবিধানের ওই সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে রায় দেন। ৩ জুলাই আপিল বিভাগও ওই রায় বহাল রাখেন। যার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পায় ১ আগস্ট।

৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে সরকার, সংসদ, রাজনীতি, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, সামরিক শাসন এবং রাষ্ট্র ও সমাজের বিষয়ে এমন অনেক পর্যবেক্ষণ উঠে আসে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘আমি ও আমিত্ব’র সংস্কৃতির বিষয়ে কড়া সমালোচনা করা হয় ওই রায়ে। বেঞ্চের অপর বিচারপতিরাও ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে তাদের অভিমত তুলে ধরেন। এরপরই রায়ে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার দেয়া পর্যবেক্ষণের তীব্র সমালোচনা করেন সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও নেতারা। এমনকি কোনো কোনো মন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতারা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে সরব হন। অবশেষে ২৪ ডিসেম্বর বহুল আলোচিত ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য সুপ্রিমকোর্টে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।

বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধিমালার গেজেট : মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনায় সরকার নিন্ম আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাবিধির একটি খসড়া করে পাঠালেও গত বছর আপিল বিভাগ তা সংশোধনের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে ফেরত দেয়। এরপর গেজেট প্রকাশের জন্য সরকারকে দফায় দফায় সময় দেয়া হয়। কিন্তু বিধিমালার গেজেট প্রকাশ হয়নি। শৃঙ্খলা বিধিমালা না করায় এক বছরের বেশি সময় ধরে সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের টানাপোড়েন চলে। একপর্যায়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, নিন্ম আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানের যে ক্ষমতা সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে দেয়া হয়েছে, তা সুপ্রিমকোর্ট নিয়ে নিতে চান। অবশেষে ১১ ডিসেম্বর বহু প্রতীক্ষিত শৃঙ্খলা বিধিমালার গেজেট প্রকাশ করে সরকার।

পিলখানা হত্যায় হাইকোর্টের রায় : পিলখানায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে হাইকোর্ট রায় দেন চলতি বছরের ২৭ নভেম্বর। এছাড়া যাবজ্জীবন দেয়া হয় ১৮৫ জনকে। আর ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয় এবং খালাস পান ৪৫ জন। নিন্ম আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ নেতা হাজী তোরাব আলীকে রায়ে খালাস দেন হাইকোর্ট।

সাত খুন মামলায় আপিলের রায় : চাঞ্চল্যকর নারায়ণগঞ্জে সাত খুন মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের ফাঁসি বহাল রেখে চলতি বছরের ২২ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত যে ২৬ আসামিকে ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আদালত। বাকি ১১ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন এবং ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড দেন। এ ছাড়া অবশিষ্ট নয়জনকে নিন্ম আদালত বিভিন্ন মেয়াদে যে সাজা দিয়েছিলেন হাইকোর্টে তা পরিবর্তন হয়নি।

বিশ্বজিৎ দাস হত্যা : চাঞ্চল্যকর বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় নিন্ম আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামির মধ্যে দু’জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল, চারজনের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন এবং অপর দু’জনকে খালাস দিয়ে ৬ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। এছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ১৩ আসামির মধ্যে যে দু’জন আপিল করেন, তারা খালাস পেয়েছেন। আসামিদের সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ কর্মী।

মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গির ফাঁসি : ২০১৭ সালে জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গির ফাঁসি ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ১৭টি হামলার মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত হরকাতুল জিহাদের (হুজির) শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নান। এ বছর আবদুল হান্নানসহ তিন জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।

অপর দুই জঙ্গি হচ্ছে তার সহযোগী শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন ওরফে রিপন। ২০০৪ সালে সিলেটে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলায় করা মামলায় ১২ এপ্রিল রাতে তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

সূত্র: যুগান্তর