বাংলাদেশের মানুষের গড় শিক্ষাকাল মাত্র ৫ দশমিক ১ বছর

0
675
blank

দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত মোট শিক্ষাবর্ষ ১৭ বছর। অর্থাৎ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে একজন নিয়মিত শিক্ষার্থীকে দীর্ঘ এ সময় পাড়ি দিতে হয়। যদিও নানা প্রতিকূলতায় দেশের অধিকাংশ মানুষই এ সুযোগ পায় না। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের মানুষের গড় শিক্ষাকাল মাত্র ৫ দশমিক ১ বছর।

একটি দেশের মানবসম্পদের মান অনেকাংশেই নির্ভর করে সে দেশের গড় শিক্ষাকালের ওপর। ২৫ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের গড় শিক্ষাকাল নির্ধারণ করে বিশ্বব্যাংক। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বেশ পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। সংস্থাটির তথ্য বলছে, বাংলাদেশে গড় শিক্ষাকাল যেখানে ৫ দশমিক ১ বছর, সেখানে ভারতে তা ৫ দশমিক ৮, শ্রীলংকায় ১০ দশমিক ৯, মালয়েশিয়ায় ১০ দশমিক ১ ও ভিয়েতনামে ৭ দশমিক ৮ বছর।

মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচক নির্ধারণের ক্ষেত্রে শিক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হিসেবে দেখে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির মতে, খুব বেশি মানবসম্পদ উন্নয়নের দেশগুলোয় গড় শিক্ষাকাল ১৩ থেকে ১৫ বছর। মধ্যম মানের দেশগুলোয় এ সময় ৮ থেকে ১০ বছর। আর নিম্ন মানের মানবসম্পদ উন্নয়নের দেশগুলোয় গড় শিক্ষাকাল পাঁচ থেকে ছয় বছর। সে হিসাবে মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান নিম্ন সারিতেই।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক স্তরে অংশগ্রহণের হার বেড়েছে, এটি সত্য। কিন্তু পরবর্তী ধাপগুলোয় এ হার সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই। অর্থাৎ প্রাথমিক শেষ করে মাধ্যমিক, মাধ্যমিক শেষ করে উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা ধাপগুলোয় শিক্ষার্থী ভর্তির হার হতাশাজনক। এ হার প্রতি বছর কিছুটা করে বাড়লেও তা কাঙ্খিত মানের নয়। অংশগ্রহণ বাড়ার পরও বিভিন্ন ধাপে ঝরে পড়ার কারণেই দেশের গড় শিক্ষাকালের হার এত কম।

তিনি আরো বলেন, দেশের গড় শিক্ষাকালের হার বাড়াতে ঝরে পড়ার হার কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। অর্থাৎ যেসব শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে তাদের যত বেশি শিক্ষাব্যবস্থায় ধরে রাখা যায়, সে চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তবে এসব উদ্যোগকে আরো কার্যকর করার সুযোগ রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, শিক্ষার্থী অংশগ্রহণের হার বাড়লেও এখনো বেশকিছু সমস্যা রয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। চলতি বছর প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৮: লার্নিং টু রিয়েলাইজ এডুকেশনস প্রমিজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে না। আবার পঞ্চম শ্রেণীর ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতের সহজ বিষয়েও ন্যুনতম স্কোর করতে পারছে না। আর্লি চাইল্ডহোল্ড ডেভেলপমেন্ট ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, নিম্ন মানের শিক্ষকতা, বিদ্যালয়ের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষা খাতে সরকারের কম বরাদ্দকে বাংলাদেশের শিক্ষাপদ্ধতির দুর্বলতার কারণ বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক।

এদিকে শিক্ষাপদ্ধতির দুর্বলতার কারণে বিদ্যালয়ে যাওয়াও ফলপ্রসূ হচ্ছে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে স্কুলে যাওয়া আর শেখা এক কথা নয়। প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে দশম শ্রেণী পর্যন্ত-এই ১১ বছর স্কুলে যায় বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের স্কুলজীবনের এই ১১ বছর সময়ের মধ্যে সাড়ে চার বছর সময়ই নষ্ট হচ্ছে দুর্বল শিক্ষাপদ্ধতির কারণে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের শিখন মান তুলনা করে এ তথ্য দিয়েছে সংস্থাটি।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ডিরেক্টর ফর এডুকেশন জেম সাভেদ্রা বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় সব শিক্ষার্থী স্কুলে যাচ্ছে। বিদ্যালয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। কিন্তু ক্লাসে যা শেখানো হচ্ছে তা অপ্রতুল। এর ফলে শেখার ক্ষেত্রে তারা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকছে। অর্থাৎ মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এদিকে শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপবৃত্তি, বিনা মূল্যে পাঠ্যবই ও খাবার বিতরণের মতো কর্মসূচির সুবাদে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ এখন প্রায় শতভাগ হলেও পরবর্তী পর্যায়ে এসব শিক্ষার্থীকে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) প্রকাশিত শিক্ষা তথ্য প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিকে ভর্তি হওয়া শিশুদের ২০ শতাংশ পঞ্চম শ্রেণী শেষ করার আগেই ঝরে পড়ে। মাধ্যমিকে গিয়ে ঝরে পড়ার এ হার দাঁড়ায় ৪০ শতাংশেরও বেশি। আর উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন না করেই ঝরে পড়ছে প্রায় ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী।

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (আইএইচডি) চেয়ারম্যান কাজী ফারুক আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, বিশ্বব্যাংক যখন কোনো তথ্য দেয়, সেটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তারা অনেক গবেষণা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এখন তারা আমাদের যে স্কুলিং ইয়ার নিয়ে তথ্য দিয়েছে, সে বিষয়ে আমাদের দেশের সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোকে খতিয়ে দেখতে হবে তা কতটুকু যথার্থ। যদি তথ্যটি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করতে হবে। পাশাপাশি স্কুলিং ইয়ার বলতে বিশ্বব্যাংক কি শুধু একাডেমিক ইয়ার নিয়েছে না নন-ফরমালসহ বলেছে, সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। কেননা আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে ফরমালের পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক উদ্যোগে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান শিক্ষার কাজ করে থাকে।