বিএনপি একাত্তরের দায় কাঁধে নিচ্ছে কেন?

0
945
blank
blank

কাজী সিরাজ: পৌরসভা নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপিকে আন্তরিক বলেই মনে হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রেও মনোনয়ন বাণিজ্য চালু ছিল বলে বেশ অভিযোগ আছে। এটা পরিষ্কার বোঝা গেছে যে, জামায়াতের সঙ্গে অতীতের মতো প্রকাশ্যে এবার আসন ভাগাভাগিতে এখনো যায়নি দলটি। জোটের বাইরে থেকে প্রায় ৫০টি পৌরসভায় মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দলীয় পরিচয়েই নির্বাচন করছে জামায়াত। প্রতীক না থাকলেও প্রচার-প্রচারণায় তারা প্রার্থীর দলীয় পদ-পদবিও ব্যবহার করছে। এসব আসনে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দ্বন্দ্ব ও ভোট কাড়াকাড়ি অনিবার্য। কেউ কেউ ইতিমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন, শুধু দলীয় প্রতীক ব্যবহার নিষিদ্ধ রেখে দলীয় পরিচয়ে তাদের নির্বাচন করতে দেওয়া উচিত কিনা। কিন্তু দলীয় পরিচয় ব্যবহার আটকাবেন কী করে? নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন বাতিল হয়েছে বলে জামায়াত দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে পারছে না, দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন করতে আইনগত বাধা কোথায়? জামায়াত তো এখনো নিষিদ্ধ কোনো দল নয়। কোনো কোনো মহল এবং শাসক লীগের হাতেগোনা কয়েকজন দ্বিতীয়-তৃতীয় সারির নেতাসহ দুই-তিনজন অতিকথক মন্ত্রী জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার কথা বললেও দলগতভাবে আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা যায়নি। সরকারও নীরব। মনে হয় এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সময় নিচ্ছেন। এ সময় নেওয়ার পেছনে সঙ্গত কোনো কারণ যে নেই তাও বলা যায় না। তিনি হয়তো ভাবছেন, দল নিষিদ্ধ করলে জামায়াতে ইসলামী নামে কোনো দল থাকবে না, জামায়াতের সাইনবোর্ড দেখা যাবে না কোথাও; কিন্তু বিগত কয়েকটি নির্বাচনের পরিসংখ্যান বের করলে দেখা যাবে তাদের প্রায় ৩০-৪০ লাখ ভোটার আছে, আছে কমিটেড একটি সুশৃঙ্খল কর্মীবাহিনী। এরা কোথায় যাবে? এদের নিষিদ্ধ করার আইনগত কী পথ আছে? এদের আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্সে ঠেলে দেওয়া কি যুক্তিযুক্ত হবে? বিষয়টি অবশ্যই জটিল বিষয় এবং ভেবেচিন্তেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপার তো বটেই।

রাজনৈতিক জটিলতায় রাজনৈতিক সমাধানের চিন্তা নিশ্চয়ই প্রশংসনীয়। রাজনীতিতে আবেগের মূল্য আছে, আবার আবেগই সবকিছু নয়। এ বাস্তবতায় জামায়াতের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাদের দলীয় পরিচয় ব্যবহার করলে নির্বাচন কমিশনের কিছুই করার আছে বলে মনে হয় না। জামায়াতের মতো সুনিয়ন্ত্রিত একটি দল এই আইনি সুযোগ কাজে লাগাতেই পারে। বিএনপি এটা জানে ও বোঝে। তারপরও পৌরসভা নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত আসন সমঝোতায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত বিএনপির জন্য সহজ ছিল না। অদূর ভবিষ্যতে ২০ দলীয় জোটে নতুন মেরুকরণ এবং একাত্তরের চেতনাবিরোধী জামায়াত নেতৃত্বকে বিএনপি অগ্নিপরীক্ষায় ফেলে দেওয়ার নতুন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারই হয়তো সূচনা করল এই কঠিন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। আজ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন কিছু মেয়র পদে জামায়াতকে ছাড় দেওয়া হলেও শুরুতেই আসন ভাগাভাগির চিন্তাটা বাদ দেওয়া কিন্তু জামায়াত সম্পর্কে বিএনপির বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানকে স্পষ্ট করেছে। এটা একটা শুভ লক্ষণ। দলগতভাবে জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে বিএনপিও কিন্তু এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। তবে এটা জানা কথা যে, দলটিকে নিয়ে বিএনপিতে স্পষ্ট দুটি ধারা বিরাজ করছে। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল গণতন্ত্রীরাই এখনো বিএনপির মূল শক্তির আধার। কিন্তু দলটির অধিকাংশ অ্যাক্টিভিস্ট এবং সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীরা বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করছে যে, দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল একটা ক্ষুদ্র চক্র দলটিতে শুধু সংগঠিতই হয়নি, এরাই সব কলকাঠি নাড়ছে। বিএনপিকে গিলে খাওয়ার জন্য এরা দেদার টাকা-পয়সাও খরচ করছে। এদের টাকার জোর আছে।

শোনা যায়, বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান অফিসের অনেক কর্মচারীই নাকি তাদের ‘পে-রোলের’ লোক। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে এরা পার্টি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে এমনভাবে ঘিরে রাখে যে, দলের যারা লাইফব্লাড, সেসব নেতা-কর্মীরাও তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারেন না। যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারা জানেন, বেগম খালেদা জিয়া যখন ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কের দলীয় কার‌্যালয়ে বসতেন, এমন কি নয়াপল্টনের দলীয় কার‌্যালয়েও যেতেন, তৃণমূলের সব নেতা-কর্মীই তার সঙ্গে দেখা করতে পারতেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে তিনিও সংগঠনের প্রকৃত অবস্থা জানতে পারতেন, জনমতের খোঁজখবর নিতেন ও পেতেন। বিরোধীদলীয় নেতা থাকাকালে ২৯ নম্বর মিন্টো রোডে যখন বসতেন, তখনো তার দরজা ছিল সবার জন্য উম্মুক্ত। মোসাদ্দেক আলী ফালু তখন তার সহকারীর দায়িত্ব পালন করেছেন। দক্ষতার সঙ্গে সব কিছু সম্পাদন করতেন দলের স্বার্থ বিবেচনা করে। দলের লোক হিসেবে সারা দেশের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও তার পরিচয় ছিল। ফলে গুরুত্ব বুঝে ব্যবস্থা নিতেন তিনি। কারও মনে কোনো ক্ষোভ ছিল না। নেত্রীর সঙ্গে তৃণমূল সংগঠনের সম্পর্ক তখন ছিল নিবিড়। এ সম্পর্কের বিষয়টাকে তখন গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হতো। যে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্যই এটা জরুরি। তা না হলেই নেতা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান কর্মীদের থেকে, আখেরে জনগণ থেকেও। যখন কোনো দলকে রাজনৈতিক ও আদর্শগতভাবে গ্রাস করার কোনো অভিসন্ধি কারও থাকে, তখন নেতা-নেত্রীকে ‘প্লান্টেড’ লোকজন দিয়ে ঘেরাও করে ফেলা হয়। এক ধরনের ‘মানবপ্রাচীর’ গড়ে তোলা হয় চারপাশে। বন্দী করে ফেলা হয় এক ধরনের ষড়যন্ত্রের কারাগারে। ওই কারাগারের প্রাচীর ভেদ করে ঢুকতে পারেন না কাজের মানুষরা, প্রকৃত আপনজনরা। বেগম জিয়াকে তেমন এক কারাগারে বন্দী রেখে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির অপচেষ্টাই বিপুলভাবে জনপ্রিয় এই দলটির জম্মকালীন ঘোষিত আদর্শ ও অঙ্গীকারকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মহান নায়ক শহীদ জিয়াউর রহমান দলের ঘোষণাপত্রের শুরুতেই যে দুটি বাক্য দিয়ে বিএনপির আদর্শ ও অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিলেন, তার সঙ্গে বর্তমান বিএনপির অনুসৃত পথ মিলিয়ে দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যাবে।

ঘোষণাপত্রে বলা আছে, ‘ঐতিহাসিক মুক্তিসংগ্রামের সোনালী ফসল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আমাদের পবিত্র আমানত এবং অলংঘনীয় অধিকার। প্রাণের চেয়ে প্রিয় মাতৃভূমির এই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুদৃঢ় ও সুরক্ষিত করে রাখাই হচ্ছে আমাদের কালের প্রথম ও প্রধান দাবি।’ একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী এবং এখনো যারা বলে একাত্তরে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, এদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই, তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে কি বিএনপি শহীদ জিয়ার এবং দলের ঘোষণা ও অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করবে? বিএনপি এখন আদর্শচ্যুত বলে যে অভিযোগ আছে, জানি না কী জবাব দেবেন দলের নেতারা। একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতার রাজনীতি করতেই পারে। এটা কোনো অপরাধ নয়। দলের আদর্শ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ক্ষমতায় যাওয়া দরকার। কিন্তু ক্ষমতার জন্য আদর্শ বিসর্জন কখনো সমর্থনযোগ্য নয়। নির্বাচনকালে কারও সঙ্গে কৌশলগত ঐক্য হতে পারে; কিন্তু সাময়িক নির্বাচনী ঐক্য যদি স্থায়ী আদর্শিক ঐক্যে রূপান্তরিত হয় তখনই দেখা দেয় বিপদ, ঘটে বিচ্যুতি। আবার কৌশলগত ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রেও লক্ষ্য রাখতে হয় লাভ-ক্ষতি কার কতটুকু হচ্ছে; বিশেষ করে সেই ঐক্য দেশ ও জনগণের জন্য কল্যাণকর কিনা। জামায়াতের সঙ্গে শাসক লীগও মাঝে মাঝে সাময়িক ‘ঐক্যের খেলা’ খেলেছে। কিন্তু জামায়াতের রাজনীতি কখনো আওয়ামী লীগকে প্রভাবিত করেনি। ১৯৯৮ সালে জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে জোট গঠনের পর বিএনপির দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, প্রগতিশীল গণতন্ত্রীদের কোণঠাসা করে ফেলে। বলাই বাহুল্য যে, দলটিতে গণতন্ত্রের ন্যূনতম কোনো চর্চা নেই। আওয়ামী লীগেও একই দশা। মূল নেতৃত্বের পৃষ্ঠপোষকতাতেই আপারহ্যান্ড পেয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলরা। দল এখন হয়ে গেছে ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তির মতো। কর্মচারী দিয়ে দল পরিচালনার দৃষ্টান্ত হিসেবে বিএনপির নাম নির্দ্বিধায় উলে­খ করা যায় সর্বাগ্রে। একাত্তরের রণাঙ্গনে যারা সাহস দেখিয়েছেন, বিএনপিতে তারা এখন কাপুরুষ হিসেবে সমালোচিত। আন্তর্জাতিক অপরাধ টাইব্যুনাল প্রদত্ত এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক বহালকৃত বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকরের পর বিএনপি আর কোনো প্রকার রাখঢাক রাখল না। ১৯ নভেম্বর যে সর্বনাশা বিবৃতিটি দলের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে, বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন কী করে তা হজম করলেন কিছুতেই বোধগম্য হয়নি। এখানে ব্যক্তি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ বা সম্পর্কের বিষয় নেই। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আÍজীবনী’ গ্রন্থটি যারা পড়েছেন, তারা নিশ্চয়ই জেনেছেন যে, সাকা চৌধুরীর পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিবারের কী সম্পর্ক ছিল। অনেকেই ধারণা করেছিলেন যে, সেই সম্পর্কের সুবাদে সাকা চৌধুরী দণ্ডমুক্ত হয়ে যাবেন। প্রাণভিক্ষা চাওয়ার পর ধারণাটা আরও পোক্ত হয়েছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্ক যে রাজনীতি এবং আইন-আদালতকে প্রভাবিত করতে পারে না এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা প্রমাণ করেছেন। তার দলের (আওয়ামী লীগের) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক প্রভাবশালী নেতার ক্ষেত্রেও একই কঠোর মনোভাব দেখিয়েছেন তিনি। এ আওয়ামী লীগ নেতা এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের সম্মুখীন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপনের পরপরই তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার শাস্তি হলে আওয়ামী লীগের কোনো রাজনৈতিক ক্ষতির কারণ নেই। বিএনপি কিন্তু তা করতে পারল না সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ক্ষেত্রে। আবদুল আলীমের ক্ষেত্রে এ দায় কিন্তু বিএনপিকে নিতে হয়নি। কেননা, তাকে আগেই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। মরহুম আবদুল আলীম সাকা চৌধুরীর চেয়েও বেশি দিন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, একাধিকবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং বিএনপি সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। বহিষ্কৃত থাকায় তার মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় এখন বিএনপিকে বহন করতে হচ্ছে না। সাকা চৌধুরীর ক্ষেত্রে বিএনপি দুটি মারাÍক ভুল করেছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। প্রথম ভুল ছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় তার বিরুদ্ধে চার্জ ফ্রেম হওয়ার পর তাকে দল থেকে বহিষ্কার না হোক, অন্তত অব্যাহতি দেওয়া। বলা যেত, বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হলে তিনি আবার তার অবস্থান ফেরত পাবেন। তাহলে বর্তমান দায়টা বিএনপির ঘাড়ে চাপত না। দ্বিতীয় ভুলটি করেছে ফাঁসি কার্যকরের পর সাকা চৌধুরী একাত্তরে কোনো অপরাধ করেননি বলে বিবৃতি দিয়ে। অথচ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর ‘কোলাবরেটর’ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার পিতাকে অপরাধী ঘোষণা করেছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, যাকে বিএনপি স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করে সেই জিয়াউর রহমান। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন চট্টগ্রামের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম মাহবুবুল আলম। ২০১২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারে তা ছাপা হয়েছিল। তিনি বলেছেন,  ‘Major Ziaur Rahman, former president and commander of Z-force during the war had commissioned termination of 22 collaborators of the then Pakistani occupation army including Salahuddin Quader Chowdhury and his father Fazlul Quader Chowdhury.  জিয়া যাকে অপরাধী বলেছেন, তার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি কেন তাকে নিরপরাধ বলল? মৃত ব্যক্তি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে এখন কুৎসা রটিয়ে লাভ নেই। এটা অনৈতিক ও অরুচিকর। ইসলামও তা অনুমোদন করে না। মৃত্যুর পর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী দলকে ইনফ্লুয়েন্সও করতে পারেননি। দলের ওই বক্তব্য স্বতঃপ্রণোদিত ছিল বলেই মনে হয় এবং উদ্দেশ্যটি ছিল রাজনৈতিক। রাজনীতিটি হচ্ছে, একাত্তরে পাকিস্তানপন্থিদের কর্মকাণ্ড কোনো অপরাধ ছিল না- এই মূল্যায়ন। কী সর্বনাশা কথা! সর্বশেষ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দুজনের দণ্ড কার্যকর হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াও স্পষ্ট করে যে, তারা পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছিলেন এবং করে যাচ্ছেন। পাকিস্তানের মানবাধিকার আন্দোলনের নেত্রী আসমা জাহাঙ্গীরও বলেছেন, পাকিস্তান তার প্রতিক্রিয়ায় প্রমাণ করল দণ্ডিত ব্যক্তিরা পাকিস্তানের চর ছিল। ১৯ নভেম্বরের বিবৃতিতে বিএনপি পরোক্ষভাবে পাকিস্তানপন্থি রাজনীতির পক্ষেই সাফাই গাইল। এ বিবৃতি পাঠকারীর নয়, দলের। যিনি বা যারা এ বক্তব্য ড্রাফট করেছেন তারা বিএনপিকে আদর্শগত প্রশ্নে নতুন করে আরেকটা বিপদেই ফেলেছেন। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বিএনপির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এ বক্তব্য সমর্থন করেন না। বিবৃতি প্রদানের পরপরই কিছুটা প্রতিক্রিয়া হয়েছে বলে মনে হয়েছে পরদিন দেওয়া বিবৃতিতে। তাতে যা বলা হয়েছে সব সাকা চৌধুরীর পরিবারকে উদ্ধৃত করেই বলা হয়েছে। পরিবার তেমন প্রতিক্রিয়া জানাতেই পারে। প্রথম বিবৃতিটিকে বিএনপির প্রকৃত রাজনৈতিক লাইন ধসিয়ে দেওয়ার একটা গভীর চক্রান্ত বলেই মনে করছেন দলের অনেক শুভানুধ্যায়ী। এসব চক্রান্তকারীকে চিহ্নিত করে বের করে দেওয়া না গেলে বিএনপিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতা রোধ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতে পারে। পৌর নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে প্রথম থেকে আনুষ্ঠানিক ও প্রকাশ্যভাবে আসন ভাগাভাগিতে না যাওয়ায় অনেক পর্যবেক্ষকই বলছেন, বিএনপির হয়তো শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে। বিশেষ করে পার্টির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় সবার কাছে এ বার্তাটিই বোধ হয় পৌঁছালেন যে, সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে অশুভ রাজনৈতিক বন্ধন ছিন্ন করতে তিনি সম্মত। জাতীয় রাজনীতিতে এর ফলে একটা গুণগত পরিবর্তন আসতে পারে। বিএনপি যদি জামায়াতের সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধন ছিন্ন করে এবং আওয়ামী লীগ যদি জামায়াতকে লুফে নিয়ে গাঁটছড়া না বাঁধে তাহলে জামায়াতের এ সাংগঠনিক শক্তি কোথায় যাবে? ধারণা করা যেতেই পারে যে, অতীতের ভুলভ্রান্তি স্বীকার করে একাত্তরের বাস্তবতা মেনে নিয়ে তাদের মধ্যেও নতুন চিন্তার উম্মোষ হতে পারে। তাদের সেই স্পেস দেওয়া যায় কিনা তাও ভাবতে হবে সবাই মিলে। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ আইএস ইত্যাদি প্রশ্নে দেশে যে গভীর রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে তার মোকাবিলায় জাতীয় রাজনৈতিক সমঝোতা এবং পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধানের একটা নবদিগন্তেরও উম্মোচন হতে পারে এতে। পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে নানা কথা কিন্তু হচ্ছে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে গত সপ্তাহে আলোকপাত করেছি। এ কমিশনকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে যেসব অভিযোগ উঠছে তা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। সরকার প্রশাসনকে ব্যবহার করে তার ‘জনপ্রিয়তা’ প্রমাণের আরেকটা ‘নাট্যোৎসব’ করতে পারে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তিন সিটি নির্বাচনের মতো।  তারপরও বলব, বিএনপির এ নির্বাচন থেকে সরে যাওয়া উচিত হবে না।  নির্বাচনে কী হচ্ছে ২৩৬ পৌরসভার জনগণ দেখবে, দেখবে বিশ্ববাসীও। এ নির্বাচন কিন্তু একটি মধ্যবর্তী জাতীয় নির্বাচনের ‘ওয়ার্মআপ ম্যাচও’ হয়ে যেতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট। ই-মেইল : kazi.shiraz@yahoo.com