বিএনপি নিজের জালে নিজেই আটকে গেছে

0
852
blank

ডেস্ক রিপোর্ট: রাজনীতিতে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আনন্দ-ক্ষোভ-হতাশা-বিক্ষোভ। ঢাউস কমিটি ঘোষণার পর বিএনপির ভেতরে-বাইরে যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তাও প্রত্যাশিত। হতাশা প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। কমিটি ঘোষণার পর ‘দলাদলির’ আলোচনায় অন্য একটি বিষয় গর্তের ভেতরে পড়ে গেছে বলে মনে করেন বিএনপির অনেকে। গত এক দশক ধরেই বিএনপির রাজনীতিতে দুঃসময় চলছে। কোনো প্রচেষ্টাতেই দলটি সময় বদলাতে পারেনি। বিএনপির ভেতরে অনেকেরই আশা ছিলো, কাউন্সিল পরিবর্তনের রাজনীতির ইঙ্গিত দেবে। কিন্তু মার্চ মাসে কাউন্সিল হলো, কমিটি ঘোষণা হলো না। অপেক্ষায় ছিলো তৃণমূল। নানা নাটকীয়তা। অবশেষে শনিবার কেন্দ্রীয় প্রায় সব নেতার নাম ঘোষণা করলেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। চাউর আছে, ঘোষণার কিছু সময় আগেই কমিটির তালিকাটি পেয়েছিলেন তিনি। এ ব্যাপারে কিছুই তার নলেজে ছিলো না।

মেগা এই কমিটি ঘোষণার পর চারদিন পার হলো। কিন্তু কোনো কিছুই বদলায়নি বিএনপির। পর্যবেক্ষকরা অবশ্য বলছেন, চার দিনে কিছুই বদলাবে না- এটাই স্বাভাবিক। বদলের জন্য এটা কোনো সময় নয়। কিন্তু বদলানোর কোনো আওয়াজও দেখতে পাচ্ছেন না পর্যবেক্ষকরা। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো দলের কমিটি ঘোষণার পরদিন দলীয় কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের ঢল নামে। ৫৯১ সদস্যের কমিটি ঘোষণার পরদিন বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ে কোনো ভিড় ছিলো না। সোমবার অবশ্য মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কার্যালয়ে যান। সেখানে বেশকিছু সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। তবে এটা হলফ করেই বলা যায়, কমিটি ঘোষণার পর ৫৯১ কেন্দ্রীয় নেতার খুব কম সংখ্যকই কার্যালয়ে গেছেন। রাজপথে এসব নেতাদের উপস্থিতি আশা করা বাতুলতা বলেই মনে করেন কেউ কেউ। রাজনীতিতে জনগণের পাশাপাশি দলীয় কর্মী-সমর্থকদেরও স্বপ্ন দেখাতে হয়। বিএনপির এই কমিটি সে স্বপ্ন দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে করেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। পরিবারতন্ত্রের জয় ঘোষণা করা কমিটি গঠনে নেপথ্যে তিন জনের ভূমিকা আলোচিত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এদের একজন আবার দলীয় প্রধানের কর্মকর্তা। যার পদচ্যুতির সম্ভাবনার খবর অতীতে অনেকবারই প্রকাশিত হয়েছে। নিউজপ্রিন্টে যা ছাপা হয় তার সবই যে সত্য নয়- এই আপ্ত বাক্য সত্য প্রমাণ করেছেন ওই কর্মকর্তা। বরং তার ক্ষমতা ইদানীং আরো বেড়েছে।

মজার বিষয় হচ্ছে, বিএনপির কমিটি গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করা ওই তিন ব্যক্তির বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে ভালো করার কোনো রেকর্ড নেই। ভোটের রাজনীতি বাংলাদেশে আর কার্যকর নেই- দিনকে দিন তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি কি তাই প্রমাণ করে। বিএনপি মহাসচিবের অগোচরে কমিটি গঠন প্রসঙ্গে বিশ্লেষকরা বলছেন, এতবড় একটি সিদ্ধান্ত যদি মহাসচিবকে না জানিয়ে হয় তাহলে ভবিষ্যতে তিনি দায়িত্ব পালন করবেন কিভাবে? মহাসচিব হিসেবেই বা তিনি কতটুকু কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবেন।

বিএনপির ভেতরেও অনেকে মনে করেন, সামনের দিনগুলোতে দলটির জন্য আরো কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতা তারেক রহমান এরইমধ্যে হাইকোর্টে দণ্ডপ্রাপ্ত। হাইকোর্টের রায় স্থগিত না হলে তার আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ নেই। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অন্তত দু’টি মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এসব মামলায় তার সাজা হলে নির্বাচনী রাজনীতিতে তার ভবিষ্যতও প্রশ্নের মুখে পড়বে। ২০১৭ সালে একটি আগাম নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়েও রাজনীতির অন্দর মহলে আলোচনা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির নবগঠিত কমিটি দলের ভেতরে তেমন কোনো আশার সঞ্চার করতে পারেনি। বরং পদ-পদবিকে ঘিরে পাওয়া-না পাওয়ার লড়াই চলছে। এক দল নেতা শুধু নিজেদের নয়, তাদের স্ত্রী-সন্তানদেরও দলে পদবি নিশ্চিত করেছেন। গণতন্ত্র নয়, এ যেন পরিবার তন্ত্রেরই বিজয়। স্থায়ী কমিটির দুটি পদ এখনও শূন্য রয়েছে। এ দুটি পদকে ঘিরেই এখন লড়াই চলছে বলে মনে হচ্ছে।

কেমন হবে বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি? নির্বাচনী রাজনীতিতে খালেদা জিয়া অংশ নেয়ার সুযোগ হারালে দলটির নেতৃত্ব দেবেন কে? নানা আলোচনা। তারেক রহমান বা আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী কি রাজনীতিতে আসছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এ সম্ভাবনা কম। জোবাইদা রহমানের রাজনীতিতে আসার বিষয়টি অবশ্য আগে আলোচনায় ছিলো। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা এ ব্যাপারে একমত হতে পারেননি। এখন তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানের কথাও শোনা যাচ্ছে। তবে সহসাই এমনটা হবে তা কেউ মনে করছেন না। এই পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোতে বিএনপির জন্য আরো কঠিন চ্যালেঞ্জই অপেক্ষা করছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। নতুন কমিটি পরিস্থিতি বদলাতে পারবে অথবা তাদের বদলানোর কোনো পরিকল্পনা আছে বিএনপির খুব বেশি লোক তা বিশ্বাস করেন না।

বিএনপির এবারের কমিটিতে সবচেয়ে বেশি অসন্তোষ জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন নিয়ে। এর মধ্য দিয়ে সিনিয়র রাজনীতিকদের বড় অংশেরই আগামীতে রাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা। তবে অন্য একটি বিষয় বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে বিএনপিকে। নতুন কমিটি একটি বিশাল রাজনৈতিক ধাক্কা হয়ে এসেছে দলের প্রগতিশীল ঘরানার নেতাদের জন্য। কমিটিতে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অনেক নেতা মামলা-হামলার শিকার, কারাভোগ করেও পদোন্নতি পাননি। উল্টো পদাবনমনের শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে আন্দোলনের সময় বিদেশে অবস্থান করে, বিগত ৬-৭ বছর রাজপথ থেকে দূরে থেকেও কেউ কেউ পেয়েছেন পদ ও পদোন্নতি। খালেদা জিয়া বিভিন্ন সময়ে নিষ্ক্রিয় নেতাদের সাংগঠনিক শাস্তির কথা বললেও বাস্তবে সেটা হয়েছে খুবই কম। বিগত ৬-৭ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে রয়েছে বিস্তর সমালোচনা। সক্রিয় ভূমিকার জন্য খালেদা জিয়ার প্রকাশ্য প্রশংসা পেয়েছিল ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল। কিন্তু কমিটিতে ছাত্রদল মূল্যায়ন পেলেও বঞ্চিত হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দল। এ সংগঠন থেকে পদ পেয়েছেন সবচেয়ে কম মাত্র ৪ জন। ওয়ান ইলেভেন বিএনপির রাজনীতিতে এনেছিল বিপর্যয়। দলের অনেক নেতাই তখন সংস্কারপন্থি সেজেছিলেন। কেউবা সংস্কারপন্থি হতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তাদের বেশির ভাগই দলে জায়গা পেয়েছেন। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে তারা অন্য কোনো দলে যাননি। সরকারের তরফে টোপ পেয়েও ধৈর্য ধরে অপেক্ষায় ছিলেন বিএনপিতে ফেরার। পদের বাইরে থেকে নানাভাবে সক্রিয় হলেও কমিটিতে ঠাঁই হয়নি তাদের।  এদিকে কমিটি ঘোষণার পর বঞ্চিত ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের শিকার নেতারা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। সিনিয়রদের বাসায় বাসায় বৈঠকও করছেন। আগামী দিনগুলোতে তারা কোন্‌ কৌশলে এগোবেন সেটা নির্ধারণের চেষ্টা করছেন তারা।

দলের দায়িত্বশীল কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে কয়েকজন নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানসহ সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সুযোগ এখনও শেষ হয়ে যায়নি দেখে এতে রাগ-অভিমান কিছুটা কমছে তাদের। এছাড়া বঞ্চিত নেতাদের ঠাঁই দিতে কমিটির পরিসর আরো কিছুটা বাড়ানোর সম্ভাবনা আছে। তবে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের বিষয়টির নিরসনে আপাতত কোনো সুযোগ দেখছেন না তারা।

সৌজন্যে: মানব জমিন