বিচারক অপসারণ ক্ষমতা থাকল না সংসদের হাতে

0
462
blank
blank

নিজস্ব প্রতিবেদক: সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করে দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ফলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে পুনর্বহালসংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় বহাল থাকল। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে গতকাল সোমবার রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে রায় ঘোষণা করেছেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন, সর্বসম্মতভাবে সরকারের আবেদন খারিজ করা হলো। তবে হাইকোর্টের রায়ে দেওয়া কিছু অভিমত প্রত্যাহার করা হবে।

এ রায় পুনর্বিবেচনায় (রিভিউ) সরকারের আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। রিভিউ আবেদন করা হবে কি না সে বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

রায়ে হাইকোর্টের দেওয়া কোন কোন অভিমত প্রত্যাহার করা হবে তা গতকাল বলেননি আদালত। এ বিষয়ে উভয় পক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, হাইকোর্টের রায়ে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড থাকাসহ বেশ কিছু মন্তব্য রয়েছে। এসব মন্তব্য প্রত্যাহার করার পক্ষে অভিমত দিয়েছেন আইনজীবীরা। ওই সব বিষয় প্রত্যাহার করা হতে পারে। তবে পূর্ণাঙ্গ রায় না দেখে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না।

আদালতের রায়ের পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের স্বপ্ন ছিল ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল ৯৬ অনুচ্ছেদে ফিরে যাওয়ার। কিন্তু তা হলো না। এ কারণে অত্যন্ত হতাশ হয়েছি। দুঃখ অনুভব করছি। ’ রায়ের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা বহাল হলো কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা আপনাআপনিই পুনর্বহাল হবে না। এ রায়ের পর একটা শূন্যতা বিরাজ করছে।

রায়ের পর রিট আবেদনকারীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেছেন, এটা ঐতিহাসিক রায়। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকলে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত না। জনগণ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতো। এ রায়ের ফলে ষোড়শ সংশোধনী বেআইনি, অকার্যকর ও বাতিল হয়ে গেল। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা রেখে জাতীয় সংসদ যে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করেছিল, সেটাই বহাল থাকল।

গতকাল সকাল ৯টায় রায় ঘোষণার জন্য নির্ধারিত ছিল। তবে বিচারপতিরা সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে এজলাসে বসেন। এর দুই মিনিট পর রায় ঘোষণা করেন। মাত্র এক মিনিটেই রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি। এরপর  বিচারপতিরা এজলাস থেকে নেমে যান।

বিচারকদের বিলম্বে এজলাসে বসার বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, গুরুত্বপূর্ণ মামলায় রায় দেওয়ার আগে বিচারপতিরা বসে আলাপ-আলোচনা করেন। এ জন্য সময় লাগে। এর আগেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলায় এভাবে আলোচনা করতে সময় নেওয়া হয়েছে।

গতকাল রায় শোনার জন্য আপিল বিভাগের ১ নম্বর আদালতকক্ষে উভয় পক্ষের আইনজীবী  ছাড়াও উত্সুক শত শত আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মী উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও। এর বাইরে অন্য কাউকে আদালতকক্ষে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। রায়ের পর বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের মধ্যে দুই মণ মিষ্টি বিতরণ করেন।

ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে গত বছরের ৫ মে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের ওপর গত ৮ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত মোট ১১ কার্যদিবস শুনানি হয়েছে আপিল বিভাগে। শুনানি শেষে গত ১ জুন আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। অন্যপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।

প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগ ওই শুনানিতে আদালতকে আইনি সহায়তা দিতে সুপ্রিম কোর্টের ১২ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ওই আইনজ্ঞরা হলেন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, বিচারপতি টি এইচ খান, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, অ্যাডভোকেট আবদুল ওয়াদুদ ভুঁইয়া, ব্যারিস্টার ফিদা এম কামাল, অ্যাডভোকেট এ এফ হাসান আরিফ, অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি ও অ্যাডভোকেট এম আই ফারুকী। তাঁদের মধ্যে ১০ জন অভিমত উপস্থাপন করেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ অসুস্থ থাকায় আদালতে যাননি। ১০ অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি ছাড়া ৯ জনই সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে পুনর্বহালসংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করার পক্ষে মত দেন।

অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য উপস্থাপন শেষ হলে আদালতে উপস্থিত সরকারদলীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু বক্তব্য দেন ইন্টারভেনর হিসেবে। তিনি ষোড়শ সংশোধনী বহাল রাখার পক্ষে মত দেন।

১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ওই ক্ষমতা দেওয়া হয় রাষ্ট্রপতির হাতে। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ওই ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে। পরে আপিল বিভাগের এক রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা হলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ব্যবস্থা রেখে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণক্ষমতা আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয় সংসদের কাছে। সে বছরের ২২ সেপ্টেম্বর এসংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয়। ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবী। ওই আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট ওই সংশোধনী কেন অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। গত বছরের ৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন তিন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। ওই রায় স্থগিত চেয়ে পরদিন আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। তিন বিচারকের মধ্যে দুজন ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। রিট আবেদনটি খারিজ করে দেন অন্যজন। দুই বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় গত বছরের ১১ আগস্ট। রিট আবেদন খারিজ করে দেওয়া এক বিচারকের রায় প্রকাশিত হয় একই বছরের ৮ সেপ্টেম্বর। দুটি মিলিয়ে মোট ২৯০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।