বিভিন্ন ধর্ম ও সভ্যতায় টুপির ব্যবহার

0
1300
blank
blank

মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ: টুপি শব্দটির বাংলা অর্থ হলো মস্তকাবরণবিশেষ বা শিরস্ত্রাণ। এটি মূলত সংস্কৃত শব্দ থেকে এসেছে। টুপির বহুল পরিচিত আরবি ‘কালানসুওয়া’। এটি ‘কালসুন’ থেকে উদগত, এর বহুবচন হলো—‘কালানিস’। ‘কালানসুওয়া’ অর্থ শিরোভূষণ। মহানবী (সা.) সর্বদা টুপি পরিধান করতেন। নামাজের সময় টুপি পরা বা মাথা ঢেকে রাখা সুন্নত। এস্তেঞ্জার সময়ও মাথা ঢেকে রাখা সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তিন বা ততোধিক টুপি ছিল। মহানবী (সা.) পাগড়ি ছাড়াও টুপি পরতেন, কিন্তু টুপি ছাড়া পাগড়ি পরতেন না।
টুপি মুসলিম উম্মাহর জাতীয় নিদর্শন। রাসুলুল্লাহ (সা.), সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন, তাবেতাবেইন, আইম্মায়ে মুজতাহিদগণসহ সব যুগে টুপি পরিধান করার প্রচলন মুসলিম সমাজে ছিল, এখনো আছে। মহানবী (সা.) টুপিকে মুসলিম ও কাফিরদের মধ্যে পার্থক্যকারী নির্ধারণ করেছেন। কাফিররা পাগড়ি পরিধান করে, কিন্তু টুপি পরিধান করে না। তাই তিনি মুসলমানদের পাগড়ির নিচে টুপি পরিধান করে বিধর্মীদের বিরোধিতা করার নির্দেশ দিতেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর টুপি
হজরত হাফিজ আবু শাইখ ইসফাহানি (রহ.) তাঁর ‘আখলাকুন নবী’ গ্রন্থে ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর টুপির বর্ণনা’ নামক আলাদা অধ্যায় সংযোজন করেছেন। সেখানে আছে : হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) সাদা টুপি পরিধান করতেন। (তাবরানি ক্বাবির : ১৩/২০৪; আল-জামিউস সগির, হাদিস : ১০০৯২)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে শামে (সিরিয়ার) তৈরি সাদা টুপি পরিহিত অবস্থায় দেখেছি।
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘সফরে নবী করিম (সা.) এমন টুপি পরিধান করতেন, যা দ্বারা কান ঢাকা যায় এবং বাড়িতে অবস্থানকালে শামে তৈরি (সাধারণ) টুপি পরিধান করতেন। (আল জামে লি আখলাকির রাবি ওয়া আদাবিস সামে : পৃষ্ঠা-২০২; তারিখে দামেশক লিইবনিল আসাকির : ৪/১৯৩; আল-জামিউস সগির, হাদিস : ১০০৯৩)
সাহাবায়ে কেরামের টুপি
সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁরা মহানবী (সা.)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। তাঁরা তা-ই করতেন, যা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করতেন কিংবা করতে বলতেন। হাদিসের কিতাবে সাহাবায়ে কেরামের টুপি পরিধানের অসংখ্য প্রমাণ আছে। হজরত হাসান বসরি (রহ.) বলেন, লোকেরা [(সাহাবায়ে কেরাম) গরমের দিনে] পাগড়ি ও টুপির ওপর সিজদা করতেন। (সহিহ বুখারি, কিতাবুস সালাত, ‘প্রচণ্ড গরমের কারণে কাপড়ের ওপর সিজদা করা’ অধ্যায়)
সুলাইমান ইবনে আবি আবদিল্লাহ বলেন, আমি প্রথম সারির মুহাজিরদের দেখেছি, তাঁরা সুতির পাগড়ি পরিধান করতেন, কালো, সাদা, লাল, সবুজ, হলুদ ইত্যাদি রঙের। তাঁরা পাগড়ির কাপড় মাথায় রেখে তার ওপর টুপি রাখতেন। তারপর তার ওপর পাগড়ি ঘুরিয়ে পরতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ১২/৫৪৫)
নামাজে টুপি পরিধানের বিধান
টুপি মুসলিম উম্মাহর ‘শিআর’ বা জাতীয় নিদর্শন। টুপি নবী কারিম (সা.) নিজে পরেছেন, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেইন তাবেতাবেইন ও পরবর্তী সময়ে সব যুগে মুসলিমগণের টুপি পরিধানের ব্যাপক আমলের ধারাবাহিকতা চলে আসছে। টুপি পরিধান করা কেবল নামাজের সুন্নত নয়, বরং সর্বাবস্থায় টুপি পরিধান করা মহানবী (সা.) থেকে প্রমাণিত।
বুখারি শরিফে হজরত হাসান বসরি (রহ.) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, সাহাবায়ে কেরাম গরমের দিনে নামাজে পাগড়ি বা টুপির ওপর সিজদা করতেন। (সহিহ বুখারি : ১/৮৬)
হজরত জুহাইর (রহ.) বলেন, আমি প্রখ্যাত তাবেই আবু ইসহাক আসসাবিইকে দেখেছি, তিনি আমাদের নিয়ে নামাজ পড়ছেন। তিনি মাটি থেকে টুপি উঠিয়ে মাথায় পরছেন। (তাবাকাতে ইবনে সাদ : ৬/৩১৪) ইমাম মালেক (রহ.) সম্পর্কেও অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়। (আলজামে, খতিব বাগদাদি : ১/৩৮৮)
তাই ফুকাহায়ে কেরাম নামাজে টুপি পরিধান করা সুন্নত বলেছেন এবং অবহেলা করে টুপি পরিধান না করে নামাজ পড়াকে মাকরুহ বলেছেন। (ফাতাওয়া কাজিখান : ১/১৩৫, রদ্দুল মুহতার : ১/৬৪০, ফাতাওয়া তাতারখানিয়া : ১/৫৬৫)
বিভিন্ন দেশ ও সভ্যতায় টুপি
মাথা ঢাকার ইতিহাসের বয়স শরীর ঢাকার রেওয়াজ চালুর প্রায় সমান। গোড়ার দিকে মানুষ মাথা ঢাকার জন্য পাতা, পশুর চামড়া, পাখির পালক ইত্যাদি ব্যবহার করত। একসময় এটি সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। রাজা, আমাত্যবর্গ ও যোদ্ধারা মাথায় মুকুট আর শিরোস্ত্রাণ পরিধান করতে থাকে। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের টুপির প্রচলন দেখা যায়। টুপির ব্যবহার ধর্মীয় হলেও ধর্মীয় অঙ্গনের বাইরে বা ধর্মীয় বিশেষ ঘরানায় আলাদা আলাদা টুপি ব্যবহারের রীতি চালু আছে। এগুলোর ব্যবহার ও ধরন হিসেবে বিভিন্ন নামও আছে। যেমন—গোল টুপি, লম্বা টুপি বা কিস্তি টুপি, পাঁচকল্লি টুপি, চারকল্লি টুপি, জিন্নাহ টুপি, গান্ধী টুপি, নেহরু টুপি, নেপালি টুপি, মালয়েশিয়ান টুপি, শামি টুপি, তুর্কি টুপি, রুমি টুপি, পাকিস্তানি টুপি, সৌদি টুপি, আরবি টুপি, জালি টুপি, তালি টুপি, বেতের টুপি, খানকা টুপি, দরবারি টুপি, পিরালি টুপি, মুরিদি টুপি, কংগ্রেসি টুপি, বিয়ের টুপি ও ঈদের টুপি।
পারস্য : উষ্ণীষের বয়স প্রায় ছয় হাজার বছর। অনেকে বলেন, পারস্যেই এর যাত্রা শুরু। প্যারিসের ল্যুভ মিউজিয়ামে পারস্যের এক দেবীমূর্তি রাখা আছে। মূর্তিটির বয়স পাঁচ হাজার বছর, দেবীর মাথায় একটি মোচাকৃতির মুকুট দেখা যায়। জরথুস্ট্র ধর্মের দেবতা আহুর মাজদার মাথায়ও টুপি বা মুকুট দেখা যায়। এ থেকে বোঝা যায়, টুপির বয়স হাজার হাজার বছর।
গ্রিস ও রোম : গ্রিসে উষ্ণীষের ব্যবহার দেখা যায় পাঁচ হাজার বছর আগে মিনোয়ান সমাজে। মিনোয়ান নারী-পুরুষ সবাই বড় চুল রাখত আর পাতা বা ধাতু দিয়ে মুকুট বানিয়ে নিত। তবে শাসক ও ধর্মগুরুরা কাপড়ের উষ্ণীষ ব্যবহার করতেন। আফগানদের পাকল নামের টুপি আর গ্রিকদের কাউসিয়া প্রায় একই রকম দেখতে। ধারণা করা হয়, গ্রিকরা এটি আফগানিস্তানের নুরিস্তানে নিয়ে আসে। গ্রিকরা পশ্চিম এশিয়ার (কুর্দিস্তান, সিরিয়া প্রভৃতি) দেশেও টুপির প্রসার ঘটিয়েছে।
চীন : খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের আগে থেকে চীনের রাজারা সিল্কের উষ্ণীষ ব্যবহার করতেন। তাঁদের টুপিতেই প্রথম রোদ থেকে বাঁচার জন্য বাড়তি অংশের ব্যবহার দেখা যায়। সাধারণ লোকজনের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠদের টুপি পরার অধিকার ছিল।
ইহুদি টুপি : টুপি ব্যবহারে ইহুদি ধর্মগুরুরা বেশ যত্নবান ছিলেন গোড়া থেকেই। মিসরে ফারাওরা মাথা-ঢাকনি ব্যবহার করতেন। রানি নেফারতিতির মুকুট দেখা যায় চোঙা আকৃতির। ইহুদিদের টুপি অন্য সব টুপির চেয়ে ছোট। অনেক ক্ষেত্রে মাথার তালুর সঙ্গে চুলের ক্লিপ দিয়ে আটকানো থাকে।
খ্রিস্টধর্ম : খ্রিস্টধর্মে টুপির ব্যবহার তেমন একটা দেখা যায় না। তবে পোপকে বিশেষ এক ধরনের টুপি ব্যবহার করতে দেখা যায়।
আফ্রিকা : আফ্রিকায় মুকুট বা উষ্ণীষের চল বহু পুরনো। তবে কাপড়ের টুপির ব্যবহার তুলনামূলকভাবে নতুন। ইসলাম ধর্ম প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আফ্রিকায় কাপড়ের টুপির ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। আরবরা টুপি ও পাগড়ি ইসলাম আসার আগে থেকেই ব্যবহার করত। তবে মহানবী (সা.)-এর সুন্নত হিসেবে অনুসারীরা এর ব্যবহার ব্যাপকতর করেন। নবীজি (সা.) পাগড়ির নিচে গোল টুপি ব্যবহার করতেন। উল্লেখ্য, জলবায়ু টুপির আকার ও গড়নে বেশ ভূমিকা রেখেছে। শীতপ্রধান অঞ্চলে পশুর চামড়া বা পশমের টুপি দেখা যায় বেশি, বিশেষত উত্তর এশিয়ায়।
লেখক: শিক্ষক, মাদ্রাসাতুল মদিনা, নবাবপুর, ঢাকা