শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী:
পবিত্র হজব্রত পালন আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ বিধান। কোরআন শরিফে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আল্লাহর তরফ থেকে সেসব মানুষের জন্য হজ ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যারা তা আদায়ের সামর্থ্য রাখে।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান; আয়াত: ৯৭)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: প্রকৃত হজের পুরস্কার বেহেশত ব্যতীত অন্য কিছুই হতে পারে না। সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যাঁরা হজ পালন করবেন, আল্লাহ তাঁদের হজ কবুল করবেন এবং তাঁদের জন্য অফুরন্ত রহমত ও বরকত অবধারিত। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, হজ ও ওমরাহর জন্য গমনকারী ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার বিশেষ মেহমান। আল্লাহ তাআলা তাঁর দোয়া কবুল করেন। কবুল হজের মাধ্যমে মানুষ নিষ্পাপ হয়ে যায়। (মুসলিম, তিরমিজি, মিশকাত)। যাঁর হজ কবুল হবে, হজের পরও চল্লিশ দিন পর্যন্ত তাঁর দোয়া কবুল হবে; এমনকি যত দিন তিনি গুনাহে লিপ্ত না হবেন, তত দিন তাঁর সব দোয়া কবুল হতেই থাকবে। ইনশা আল্লাহ!
হজ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সুবিদিত মাসসমূহে হজব্রত সম্পাদিত হয়। অতঃপর যে কেউ এই মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে, তার জন্য অশ্লীলতা, কুৎসা, অন্যায় আচরণ, ঝগড়া ও কলহ-বিবাদ বিধেয় নয়।’ (সুরা-২ বাকারা; আয়াত: ১৯৭)। তাই হজের সফরে সর্বদা তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করে চলতে হয়। কারও ব্যবহার পছন্দ না হলেও রাগ করা যায় না বা কটু কথা বলা যায় না, কারও মনে কষ্ট দেওয়া যায় না। কারও দ্বারা যদি কারও কোনো ক্ষতি হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হয়। অন্যের বিপদে সর্বদা সাহায্য করার চেষ্টা করতে হয়। খেদমত করাকে সৌভাগ্য ও গৌরবজনক মনে করতে হয়। নিজের স্বার্থ আগে উদ্ধার করার মানসিকতা পরিহার করতে হয়। নিজের ওপর অন্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ভোগের ইচ্ছা পরিত্যাগ করতে হয়। ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরম পরাকাষ্ঠা দেখাতে হয়। উদ্দেশ্য হলো হজ-পরবর্তী জীবনে নিজেকে সৎ গুণাবলিতে গুণান্বিত ও সুশোভিত করা।
পৃথিবীর সব মানুষ একই পিতা-মাতার সন্তান। মানুষের পরিচয় একটাই, সে মানুষ। তাই মানুষে মানুষে কোনো প্রকার ভেদাভেদ নেই, পদ-পদবি ও অবস্থানগত পার্থক্য মানুষের মধ্যে যে অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে, হজের মাধ্যমে তা দূর হয়। তাই হজকে মানবতার প্রশিক্ষণ বলা যায়। হজের ছয় দিন (৮ জিলহজ থেকে ১৩ জিলহজ পর্যন্ত) এই প্রশিক্ষণ কোর্সের মেয়াদকাল। ৭ জিলহজ তারিখে সব হাজি মিনার তাঁবুতে গণবিছানায় গিয়ে একাত্মতার ঘোষণা দেন। ৯ জিলহজ তারিখে হাজিরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে ঐক্যের অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেন; মিলিত হন আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলনে। ৯ জিলহজ দিবাগত সন্ধ্যা, ১০ জিলহজের রাতে হাজিরা মুজদালিফায় গিয়ে সব কৃত্রিমতার অবসানের মাধ্যমে মানবতার পূর্ণতা ও আদি আসল প্রকৃত মানবরূপ লাভ করেন। সবার পায়ের নিচে মাটি, মাথার ওপরে খোলা আকাশ, সবার পরনে একই কাফনের কাপড়। পোশাকে বাহুল্য নেই, খোলা মাথা—পাগড়ি, টুপি ও লম্বা চুলের আড়ম্বর নেই; সঙ্গে সেবক-কর্মচারী নেই, গন্তব্য এক হলেও রাস্তা জানা নেই—চেনা রাস্তাই যেন অচেনা, নিজের শক্তি-সামর্থ্য ও জ্ঞান-গরিমার প্রকাশ নেই, বুদ্ধি-বিবেচনা ও কৌশল প্রয়োগের সুযোগ নেই; শুধুই আল্লাহর ওপর ভরসা করা। এটিই মানবতার পূর্ণতা, এটিই হজের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও আসল শিক্ষা।
শয়তানকে পাথর মারা একটি প্রতীকী বিষয়। শয়তানের প্ররোচনা ও তাড়না থেকে নিজেকে রক্ষা করা এবং মনোজগতে শয়তানি শৃঙ্খল বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার ও সকল প্রকার শয়তানি ভাব ও প্রভাব মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে একমাত্র বিবেকের অনুসরণে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলার ইবাদত তথা আনুগত্য করাই হলো শয়তানকে পাথর মারার মূল রহস্য।
হজ ঐক্য ও উদারতা শেখায়। সব দেশের, সব বর্ণের, সব পেশার, সব শ্রেণির, সব মতের মানুষ একই ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করেন। এত ভিন্নমতসহ ঐক্যের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ সহাবস্থান করেন বলে ভাষার দূরত্ব দূর হয়ে মনের নৈকট্য অর্জন হয় এবং প্রকৃত মানবিক অনুভূতি জাগ্রত হয়। মনের সংকীর্ণতা দূর হয়; দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয়, চিন্তার বিকাশ সাধিত হয়। একদেশদর্শী মনোভাব দূর হয়ে দূরদর্শিতা লাভ হয়।
যাঁরা হজকে জীবন পরিবর্তনের অপূর্ব সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং হজ-পরবর্তী জীবনে হজের শিক্ষা বজায় রেখে জীবন পরিচালনা করেন, তাঁরাই প্রকৃত হাজি। এ রকম হাজির সংখ্যা বাড়লে দেশ ও জাতির মঙ্গল সাধিত হবে, জনমানুষের কল্যাণ হবে; অন্যথায় অর্থের অপচয়, সময়ের অপচয়, শক্তি-সামর্থ্যের অপব্যবহার ও নফসের গোলামি বা আত্মপূজাই সার হবে। হজ শুধুই ইবাদত। এটি কোনো সার্টিফিকেট কোর্স নয় বা অর্জিত পদ-পদবিও নয়। তাই হজ করার পর নিজ থেকেই নামের সঙ্গে হাজি বিশেষণ যোগ করা সমীচীন নয়। অন্য কেউ তা বললে অসুবিধা নেই।
হজ কবুল হওয়া বা না হওয়ার নিরিখে তিন প্রকার। যথা: হজে মাবরুর, হজে মাকবুল ও হজে মারদুদ। হজে মাবরুর মানে হলো সর্বোত্তম হজ। হজে মাবরুর হলো যে হজ সব মানদণ্ডে শতভাগ মানোত্তীর্ণ হয়; হজে মাকবুল মানে হলো যে হজ কবুল হয়েছে বা কবুল হজ। হজে মাকবুল এটিও মানোত্তীর্ণ হজ। হজে মারদুদ মানে হলো রদ তথা পরিত্যাজ্য বা পরিত্যক্ত তথা বাতিলকৃত হজ, অর্থাৎ যে হজ কবুল হয়নি বা বাতিল হয়েছে। হজ বাতিল হতে পারে নিয়ত বিশুদ্ধ না হলে বা উদ্দেশ্য সঠিক না থাকলে। হজের অর্থ হালাল না হলে বা বৈধ উপার্জন না হলে। হজের ফরজ, ওয়াজিব তথা আরকান-আহকাম সঠিকভাবে আদায় করা না হলে। হজের সময় নিষিদ্ধ কোনো কর্ম সম্পাদন করলে। সর্বোপরি হজের শিক্ষা অর্জন না করলে বা হজের উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হলে।
হজ কবুল হলো কি হলো না তা শুধু আল্লাহ তাআলাই জানেন। তবে হজ কবুলের কিছু বাহ্যিক আলামত বা নিদর্শন রয়েছে। যেমন: যাঁরা হজের পরে কাজে-কর্মে, আমলে-আখলাকে, চিন্তাচেতনায় পরিশুদ্ধি অর্জন করবেন বা পূর্বাপেক্ষা উন্নতি লাভ করবেন, তাঁরাই হলেন প্রকৃত হাজি। কিন্তু যাঁরা হজ করার পরও কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন বা উন্নতি সাধনে ব্যর্থতার পরিচয় দেবেন, তাঁরা হলেন হজে মারদুদ সম্পাদনকারী। হজ করা বড় কথা নয়; জীবনব্যাপী হজ ধারণ করাই আসল সার্থকতা।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
সম্পাদক ও প্রকাশক: শিব্বির আহমদ ওসমানী [এমএ, এলএলবি (অনার্স), এলএলএম] যোগাযোগ: বনকলাপাড়া রোড, সুবিদবাজার, সিলেট- ৩১০০। ই-মেইল: damarbangla@gmail.com ফোন: ৭১৪২৭১, মোবাইল: +৮৮ ০১৭১৪৪৫৭৭৯২ www.dailyamarbangla.comCopyright © 2024 Daily Amar Bangla. All rights reserved.