ব্যক্তি-সরকার-রাষ্ট্র, এই বৃত্তটিই আক্রান্ত চাপাতিওয়ালাদের হাতে

0
1219
blank
blank

মাসুদা ভাট্টি: পশ্চিমের বন্ধুরা জানতে চায়, বাংলাদেশে এ সব কী হচ্ছে? তারা দ্বিতীয় প্রশ্ন করে, কারা করছে এ সব? তৃতীয় প্রশ্ন করে, সরকার কেন এদের দমাতে পারছে না? এবং তারপরের প্রশ্ন তাদের, এরপর কী হবে? বা এর পরিণতি কী হতে পারে? আমার ধারণা, এই প্রশ্নগুলো কেবল পশ্চিমের বন্ধুদের নয়, এই প্রশ্ন আমাদেরও। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন করার জায়গা নেই, কারণ, আমরা জানি যে, এ সব প্রশ্নের উত্তর কেউ দেবে না আমাদের। সুতরাং আসুন নিজে নিজেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।

প্রথমত, এই প্রশ্নটি উত্থাপন জরুরি যে, বাংলাদেশ আসলে কোন দিকে হাঁটছে? একের পর এক ব্লগার হত্যার পর সরকার নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে? এবং এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়ায়ই বা কিভাবে এগুচ্ছে? এই তিনটি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই যে, প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরেই কোনও সঠিক দিকনির্দেশনামূলক উত্তর আমাদের সামনে নেই। বিশেষ করে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা কোনও ধরনের স্পষ্ট বক্তব্য এখনও পাইনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত কি না, তা বলতে পারব না কিন্তু তার আশেপাশের কাউকে অন্তত এসব বিষয়ে সরাসরি কোনও বক্তব্য দিতে শোনা যায়নি। একেকটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বালখিল্য  উক্তি ছাড়া বক্তব্য হিসেবে সরকারের অবস্থান এখনও ব্যাখ্যা করা হয়নি। যে কারণে আমরা কেবল অন্ধকারে আছি তাই-ই নয়, অন্ধকারে খুন হচ্ছি। সরকারের এই অবহেলা জনগণ যে বেশিদিন সহ্য করতে পারে না তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সেদিকে সরকারের কোনও খেয়াল আছে বলে আমরা মনে করি না।

সরকার আমাদের উন্নয়ন দিচ্ছে, উন্নয়নের স্বপ্ন দেখাচ্ছে, পেটে-ভাতে রাখছে, সব মানছি, কিন্তু যাদের জন্য এত সব আয়োজন-উন্নয়ন, সেই মানুষই যদি না থাকে, তাহলে উন্নয়ন ধুয়ে যে আসলেই পানি খাওয়া যাবে না, তা সরকারকে বোঝানোর মতো কেউ আছে বলেও তো বোঝার উপায় নেই। রাষ্ট্রের অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া যত কঠিন হবে, ততই অপরাধ কমবে, আধুনিক অপরাধ-বিজ্ঞান সে কথা স্বীকার করে (ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়) কিন্তু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে এই বিচার প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চলে। ধরে নিচ্ছি, ব্লগারদের হত্যাকাণ্ড, হত্যাচেষ্টা এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের প্রক্রিয়ার মধ্যে ‘ধর্ম’ একটি বিশাল প্রশ্নের ব্যাপার। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গণজাগরণ মঞ্চের পরে বাংলাদেশকে ধর্ম দিয়ে আড়াআড়ি ভাগ করে দেওয়ার কাজটি করেছে বিএনপি-জামায়াত জোট। সরকার সেই আড়াআড়ি ভাগের কোন ভাগে নিজেদের রেখেছে, সে কথা জনগণের সামনে স্পষ্ট নয়। বিএনপি-জামায়াতের অবস্থান এক্ষেত্রে খুবই স্পষ্ট, তারা মনে করছে যে, বাংলাদেশে ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের কোনও জায়গা নেই, হয় তাদের মরতে হবে, নাহলে দেশ ছাড়তে হবে (এখানে বলে রাখাটা জরুরি যে, ব্লগার মাত্রেই যে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপনকারী, তা নয়; গণজাগরণ মঞ্চের তরুণদের অনেকেই নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে কিন্তু তা জামায়াত-বিএনপি’র কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা ধরেই নিয়েছে যে, যে সকল তরুণ-যুবক মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে তারা মূলত, বিএনপি-জামায়াতের শত্রু, অতএব তাদের যদি ইসলামবিরোধী ট্যাগ দেওয়া যায় তাহলে আখেরে তারাই লাভবান হচ্ছে, দুদিক থেকেই)।

কিন্তু ওপরের এই সমস্যায় সরকারের অবস্থান কোথায়? আমরা প্রধানমন্ত্রী পুত্র এবং একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের  সাক্ষাৎকারের সূত্রে জানি যে, সরকার আসলে ধর্মনিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাস করে (?)। কিন্তু একই সঙ্গে সরকার ইসলামবিরোধীদের সঙ্গে নেই, আগেই বলেছি যে, ইসলামের সমালোচনা আর ইসলামবিরোধিতা যে এক নয়, সেকথা আমরা কোনও পক্ষের বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার বুঝতে পারিনি। এরপর যখন থেকে বাংলাদেশে ব্লগারদের চিহ্নিত করে হত্যা এবং আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে তারপর থেকে সরকারের ভূমিকা মূলত দায়িত্ব এড়ানোর। বিশেষ করে, এখনও কোনও ব্লগার হত্যা বা হত্যাচেষ্টার আসাসিদের গ্রেফতার করা এবং আইনের আওতায় আনার কোনও উদাহরণ আমাদের সামনে নেই।  বরং যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের জামিন দেওয়ার উদাহরণ রয়েছে এবং জামিনে মুক্তদের অনেকে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছে বলে সংবাদ-মাধ্যম থেকে জানা গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো, ব্লগার, ইসলামবিরোধিতা এবং উগ্রপন্থীদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাষ্ট্র একটি ভয়ঙ্কর সময় অতিক্রম করছে। এই ভয়ঙ্কর সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে এমন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি যেন লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত, মুক্তমনা মানুষগুলো খানিকটা হলেও স্বস্তি পেতে পারে। কিন্তু সরকারের অবহেলা এবং এড়িয়ে যাওয়ার নীতির ফলে যদি কেউ উৎসাহ লাভ করে থাকে তাহলে তারা আর কেউ নয়, ওই উগ্রবাদী, ধর্মান্ধ শ্রেনীটি, যারা বাংলাদেশকে একটি ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে। এদের পক্ষে বিএনপি-জামায়াতের অবস্থান তো স্পষ্টই পরিষ্কার, কিন্তু এখন স্পষ্ট হচ্ছে যে, সরকারও এদের বিরুদ্ধে নয়, বরং প্রয়োজন হলে এদের আশ্রয়ও হয়তো সরকার দেবে।

দেখুন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়বদ্ধতা কিংবা কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন করতে চাই না। কারণ, তারা সরকারের নির্দেশে চলা একটি বাহিনী মাত্র। কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র তুলতে পারি, এই বাহিনীগুলোর ভেতরে উগ্রবাদকে সমর্থন দেওয়ার মতো মানসিকতা রাখেন এমন মানুষের সংখ্যা কত? এর কোনও উত্তর আমাদের জানা নেই। কিন্তু দেশব্যাপী সাধারণ জনগণকে যেভাবে রাজনৈতিকভাবে ধর্ম দিয়ে উস্কে দেওয়া হয়েছে, তাতে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, এইসব বাহিনীর মাঝেও উগ্রবাদ তথা ইসলাম নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনাকারীদের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হওয়ার মতো মানুষের অভাব নেই। সরকার হয়তো কোনও একদিন আমাদের বলবে যে, তারা চাইলেও ব্লগারদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি, কারণ যাদের দিয়ে নিরাপত্তা দেওয়া হবে, তারা সরকারের নির্দেশ মানেনি। কিন্তু সেটা যে সরকারের দুর্বলতা এবং দুর্বলদের যে জনগণ রাষ্ট্র পরিচালকের ভূমিকায় দেখতে চায় না, সে কথাটি সরকারের মনে রাখাটা জরুরি বলে মনে করি।

হত্যাকারীরা এখন লেখক, ব্লগারদের সঙ্গে তাদের প্রকাশকদের হত্যা করতে শুরু করেছে। বন্ধু আহমেদুর রশীদ টুটুল আমার নিজেরও প্রকাশক। দীপেনের সঙ্গেও জানাশোনা ছিল। বাকি যারা আহত হয়েছেন, তাদের সঙ্গেও ব্যক্তিগত জানাশোনা ছিল। আমি নিশ্চিত যে, এরপর তালিকা ক্রমশ বাড়তে থাকবে। কারণ সরকার আমাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আগেই বলেছি যে, সরকারের কর্মকাণ্ড বরং হত্যাকারীদের জন্য উৎসাহ-ব্যঞ্জক। আর এই হত্যাকারী ও আক্রান্তদের মাঝে দাঁড়িয়ে দেশের সুশীল সমাজ কেবল সরকারের দিকেই সমালোচনার তীর হেনে চলেছেন। তাদের এই সমালোচনা অযৌক্তিক কিংবা অকারণ, সে কথা মোটেও বলছি না। বরং অত্যন্ত যৌক্তিক এবং এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে কিন্তু তাতে কোনও প্রকার দিকনির্দেশনা যে বেরুচ্ছে না, মানুষের ভেতর থেকে শঙ্কা যে দূর হচ্ছে না, তাও কিন্তু সত্য। তাহলে, এরপর কী?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বলতেই হয় যে, আমরা অত্যন্ত দুঃসময় অতিক্রম করছি। নড়বড়ে রাষ্ট্র-চরিত্র নিয়ে বাংলাদেশ আসলে এই অবস্থার ভেতর এমনিতেও পড়ত, সে কথা অনেক বিশ্লেষকই আগে বলেছেন। বিশেষ করে, বাংলাদেশ পাকিস্তান হবে নাকি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বহুদিন যাবতই একথা বলা হচ্ছে যে, রাষ্ট্রকে একথা বলতে হবে স্পষ্ট করে যে, বাংলাদেশ আসলে কেমন থাকতে চায়। একমাত্র তাহলেই জনগণ বাধ্য হয়েই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, নিজেদের ধর্মবিশ্বাসকে নিজের ভেতর রেখে বৃহৎ পরিসরে উদার গণতান্ত্রিক ধারার প্রতি সম্মান দেখাতে। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, মুখে উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা বললেও, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র চরিত্রে তার প্রয়োগের চিহ্ন এখন পর্যন্ত খুব সামান্যই। এতে হিতে বিপরীত হয়েছে, রাষ্ট্রবিরোধীরা উৎসাহী হয়েছে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিরাপদ রাখার দায়িত্বপ্রাপ্তরা তাদের ধর্মবিশ্বাস দিয়ে প্রভাবিত হয়ে দায়িত্ব পালনে অবহেলা দেখানোরও সুযোগ পেয়েছে বা ভবিষ্যতে পেতে পারে। আর আমরা তো জানিই যে, এই হত্যাকারীদের কেবল একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমই নেই, দেশের ধর্মভীরু জনগণের সমর্থনও তারা পেতে পারে বলে তারা মনে করতেই পারে। রাষ্ট্রের ভেতরকার এই অস্থিরতা ব্যক্তি জীবনকেও যে বড় ধরনের সমস্যায় ফেলতে পারে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার রাষ্ট্রচরিত্র ঠিক করে উঠতে পারেনি বলেই জনগণও কোনও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নিজেদের অবস্থানকে স্পষ্ট করতে পারছে না। এটা ভয়ঙ্কর এবং আত্মঘাতী একটি সমস্যা।

আমরা একের পর এক বন্ধু-স্বজন হারাচ্ছি আর টের পাচ্ছি রাষ্ট্রের এই দুর্বলতার খবর। আর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে হত্যাকারীরা আজ সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে, একের পর এক হুমকি দিয়ে চলেছে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে, সোস্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে। হয়তো এসব ব্যক্তি-আক্রমণ ভেবে রাষ্ট্র নিজেকে নিরাপদ মনে করছে, সরকারও নিজেকে আক্রান্ত ও আক্রমণকারীর মাঝামাঝি কোনও জায়গায় নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু একটু চোখ খোলা থাকলেই দেখতে পেত যে, এই আক্রান্ত ও আক্রমণকারীরা সত্যিকার অর্থে কেবলই দুটি পক্ষ, এক. আক্রান্ত, যে দলে রাষ্ট্র, সরকার এবং রাষ্ট্রের প্রায় সব নাগরিক এবং দুই. আক্রমণকারী কেবল, ওরা যাদের কথা আমরা কেবল জানি, যাদের রাজনীতি সম্পর্কে জানি কিন্তু তাদের নিষ্ঠুরতা কেবল দেখতে শুরু করেছি আমরা। একাত্তরে গণহত্যা এবং আশির দশকে রগ-কাটা রাজনীতি দিয়ে যার উদ্বোধন ঘটেছিল, আজকে সেই হত্যাকারীরা চাপাতি হাতে নিয়ে রাষ্ট্রে ধর্মবিপ্লবের মহড়া দিতে শুরু করেছে। আর সরকার এখনও চুপচাপ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, দেখি না, এরপর কী হয়? কী আর হবে, একেকজন নাগরিক চাপাতির কোপে আহত-নিহত হচ্ছেন আর সরকার একেকটি উইকেট হারাচ্ছে, এরপর সরকার পড়বে এবং তারপর রাষ্ট্র; ব্যক্তি সরকার চালায় এবং সরকার রাষ্ট্র—এই বৃত্ত এখন আক্রান্ত চাপাতিওয়ালাদের হাতে। বৃত্তের এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুর দূরত্ব খুব বেশি নয়, তা সে বৃত্ত যত বড়ই হোক না কেন।

লেখক: কবি ও কলামিস্ট।

ইমেইল: masuda.bhatti@gmail.com