মূল্যবোধের ধস নেমেছে

0
589
blank
blank

হারুন-আর-রশিদ: বহুদিন ধরে আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশ থেকে শান্তি পলাতক। দেশটি ১৯৭১ সালে স্বাধীন করা হয়েছিল শান্তির জন্য। উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। বাস্তবে দেশের পরিচালকেরা সেটা ধরে রাখতে পারেননি। বলতে গেলে ব্যর্থ হয়েছেন। এ জন্য প্রথমে দায়ী করা যায় রাজনীতিবিদদের। কারণ দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে দেশটা তারাই চালিয়েছিলেন- অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার হাল প্রথমে তারাই ধরেছিলেন। সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যর্থতার দায় রাজনীতিবিদদের ওপরই বর্তায় এ কারণে।
শান্তির লক্ষ্যে কাজ করার জন্য প্রথম প্রয়োজন হয় সহমর্মিতার, যা প্রকাশ পায় একজনের কাঁধে অন্যজনের হাত রাখার ভঙ্গিতে। একমাত্র মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তাই মানুষকে দেয় উদারতার শিক্ষা, যা পরস্পরকে চেনার জন্য অতীব জরুরি। একই কথা বলা যায় শ্রদ্ধা সম্পর্কেও। শ্রদ্ধা ছাড়া মানুষে-মানুষে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। একে অপরকে চিনতে জানতে হলে শ্রদ্ধা ছাড়া তা অর্জন করা সম্ভব নয়। জাতির মধ্যে শ্রদ্ধাবোধের অভাব প্রকোট। শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রত্যেকের মধ্যে দরকার দায়িত্ববোধ। কেউ আমাদের সমস্যা দূর করতে আসবে না। দূর করতে হবে আমাদেরই। উদারতা, সহমর্মিতা, দায়িত্ববোধ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছাড়া মানুষে মানুষে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা যায় না। সম্প্রীতি আত্মোৎসর্গ, স্বাধীনতা, সৌহার্দ্য পরমতসহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা, মুক্তচিন্তা, শ্রদ্ধা, দায়িত্ববোধ, ভালোবাসা, মৈত্রী এবং শান্তির বাণী মানসিক মূল্যবোধের এ বিষয়গুলো তুলে ধরা অতীব জরুরি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে। দেশে মানবিক মূল্যবোধের খরা দূর করতে হলে এসব চর্চা রাষ্ট্রীয়ভাবে ধারণ ও লালন করা দরকার।
দুঃখজনক সমাজ আশা জাগালেও রাজনীতি আমাদের হতাশ করে সর্বক্ষণ। বর্তমান রাষ্ট্রের চরিত্র অ্যান্টিপিপল, কারণ মানবসেবা আদায় করতে হলেও সব সেক্টরে ঘুষ দিতে হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা কতজন ভাবি, ঢাকার পরিবেশ কিভাবে সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা যায়। নিঃসন্দেহে বলা যায়- নগরে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে এ সংখ্যা ৩ থেকে ৫ শতাংশের বেশি হবে না। অনেকেই আমাদের এক সময়ের গর্ব ঢাকাকে গালাগালি করেন এভাবে বর্জ্যরে শহর ঢাকা, বিদ্যুতের যন্ত্রণা, বিশুদ্ধ পানির কষ্ট আর সইতে পারি না। গণপরিবহনে ওঠানামার যন্ত্রণা, পাশাপাশি যানজটের দুর্ভোগ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, খানাখন্দে পথ চলায় নিদারুণ কষ্ট, নাগরিক ফুটপাথে পথচলা দায় ভাসমান হকারদের কারণে, বারোয়াটি বর্জ্য নাগরিক বিভিন্ন এলাকায় যত্রতত্র অবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে পড়ে আছে- নাকে রুমাল দিয়ে দুর্গন্ধ, ঢেকে রাখা যায় না, গণপরিবহন ও জনপরিসরে থেমে নেই ধূমপান, প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া চলছে- ফুটপাথে ও উন্মুক্ত মাঠে। বড় গর্ত ও ম্যানহোলগুলো হাঁ করে তাকিয়ে আছে মানুষকে বিপদগ্রস্ত করার জন্য। নগরীর বিশেষ বিশেষ এলাকায় গ্যাস এই আসে, এই যায়। এভাবেই ঢাকাকে নিত্যদিন ঘুম থেকে উঠে দোষারোপ করছি। এসব সমস্যার লাঘব বা পরিত্রাণ কিভাবে হবে, তা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ কোনো প্রয়াস আদৌ দৃশ্যমান নয়। সরকার ও বিরোধী দল দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে ভাবনা কম। তাদের ভাবনা ক্ষমতার রাজনীতি। কিভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়। আরেক পক্ষের ভাবনা কিভাবে ক্ষমতায় যাওয়া যায়। ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রয়োজন জনগণের রাজনীতি। এক কথায় যার উত্তর মানবসেবার রাজনীতি। সেই রাজনীতি দেশে প্রায় তিন দশক ধরে নেই বললেই চলে। দুই বড় দলের ক্ষমতার রাজনীতির কারণে বহু মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। পঙ্গু হতে হয়েছে চিরতরে- এ সংখ্যাও প্রায় ৫০ হাজারের ঊর্ধ্বে হবে। তিন দশকে নিহতের সংখ্যাও প্রায় ৪০ হাজার হবে বলে বিভিন্ন মিডিয়া সেল থেকে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। তাদের এই নষ্ট রাজনীতির কারণে দেশ এবং সাধারণ মানুষের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ‘মানুষের কল্যাণে রাজনীতি’ এই মিথ্যা স্লোগান দিয়ে তাদের নিজেদের আয়রোজগার ঠিকই বেড়েছে। বীমা, ব্যাংক, টিভি চ্যানেল, ব্যবসায় বাণিজ্য, বাড়িগাড়ি, ফ্ল্যাট, দেশে-বিদেশে ব্যাংক ব্যালেন্স, বিদেশে সেকেন্ড হোম ইত্যাদি সব কিছুই রাজনীতির আড়ালে অর্জন করতে পেরেছেন রাজনৈতিক ব্যবসায়ীরা। এ জন্য অনেকের মুখ থেকে শুনেছি রাজনীতি বাংলাদেশে স্রেফ একটা রমরমা ব্যবসা। এখানে জনগণের কল্যাণের কোনো চাষ আবাদ হয় না।
রাজনীতিতে ব্যক্তি কর্তৃত্ব প্রকট। রাজনীতিতে গণতন্ত্র অনুপস্থিত। দলের ভেতরে কোনো গণতন্ত্র নেই, তাহলে রাষ্ট্রে থাকবে কিভাবে। দেশে সঙ্ঘাতের রাজনীতি-রাজনৈতিক দলগুলোর কারণেই সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ভালো সম্পর্ক থাকলে সঙ্ঘাতের রাজনীতিও থাকত না। বাংলাদেশ তাত্ত্বিকভাবে গণতন্ত্র, সুষ্ঠু দল পরিচালনার ব্যবস্থা ও বহুত্ববাদের ধারক হলেও প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিশাল ব্যবধান লক্ষণীয়। বিগত ৪৪ বছর বাংলাদেশ দল পরিচালনা হয়েছে নেতা বা ব্যক্তি-কেন্দ্রিক। গণতন্ত্রের লক্ষ্যপূরণ হিসেবে নির্বাচনকে বিবেচনা করা হলেও নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দলীয় উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়। যে দল নির্বাচনে হেরে যায়, তার ওপর সুনামি শুরু হয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ- বর্তমান দেশে পরাজিত বৃহত্তম বিরোধী দলের মহানগরীর সব ক’টি কার্যালয় বন্ধ। পুলিশ ও র্যারব প্রহরায় থাকছে এসব কার্যালয়। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই দেশে নষ্ট রাজনীতির উত্থান ঘটেছে।
৩১-০৩-১৫ দেশের একটি জাতীয় দৈনিক লিখেছে- দেশের বর্তমান অবস্থা এমন পর্যায় পৌঁছেছে যে মসজিদের ইমামরাও আল্লাহর চেয়ে মসজিদের সভাপতি ও থানার ওসিকে বেশি ভয় পান। সে জন্য তাদের কথা মেনে চলেন। পাবলিক প্রশাসনে রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে চরমভাবে। উদাহরণস্বরূপ, পুলিশের মেজবান অনুষ্ঠানে ডিআইজি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কটূক্তিকারীদের জিহ্বা কেটে দিন (সূত্র নরসিংদী জেলা সংবাদদাতা, দৈনিক ইনকিবলাব, ৩১-০৩-২০১৫)। রাজনীতিবিদেরা যেসব কথা বলবেন, সেইসব কথা এখন বলা শুরু করেছে সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন- এটা দেশের জন্য অশুভ বার্তার ইঙ্গিত। সমাজের বরেণ্য ব্যক্তিরা আজ মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় নিয়ে মুখ খুলেছেন। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ দুদকের উদ্দেশে বলেছেন- দুদককে আমরা যতই স্বাধীন বলি না কেন, মূলত রাজনীতি গ্রাস করেছে এসব সংস্থাকে। আমরা বলি, সরকারও জোরগলায় বলে দুদক স্বাধীন, নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন স্বাধীন। এরপরও এসব সংস্থা নিয়ে এত গোলমাল হয় কেন। এদের বিরুদ্ধে এত কথা ওঠে কেন। কারণ এরা স্বাধীন নন। এ জন্য সরকারকেই ভূমিকা নিতে হবে। দেশের এমন কোনো স্থান নেই যেখানে চরম দুর্নীতি বিরাজ করছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক পর্যন্ত লুণ্ঠন করছে। আমরা এখন গোটা জাতিকে দস্যুতার দিকে ধাবিত করছি। দুর্নীতি সমাজে যত বাড়বে সমাজ তত দরিদ্র হবে। দুদক স্বচ্ছ- সেটা প্রমাণ করতে দুদকও ব্যর্থ হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান না চালালে দুর্নীতি দমনের স্বপ্ন ব্যর্থ হবে।
আমরা জানি এবং দেশের প্রচলিত আইনি বিধানও সে কথা বলে যে, বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ড মারাত্মক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু সমাজে আজ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে সুনামির গতিতে। সরকারি বাহিনী, র্যা ব ও পুলিশের গুলিতে যারা মারা যাচ্ছে, তাদের মৃত্যুকে বলা হচ্ছে- সন্ত্রাসীদের সাথে কার্যত বন্দুকযুদ্ধে বা ক্রসফায়ারে তারা মারা গেছে। এ মৃত্যুর তালিকা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী দীর্ঘ। যুদ্ধ যখন হয়, তখন দুই পক্ষই মারা যায় এবং আহত হয় দুই পক্ষই। কিন্তু কার্যত বন্দুকযুদ্ধে আহত বা নিহতের তালিকায় সরকারি বাহিনীর নাম নেই বললেই চলে। আমরা যে কথাটি বলতে চাচ্ছি, যারা মৃত্যুবরণ করছে, তারা সন্ত্রাসী না নিরীহ মানুষ তার প্রমাণ তো আদালতেই সাব্যস্ত করার নিয়ম। অপরাধী হলেও তার অপরাধ প্রমাণ করে আইনি বিধানে শাস্তি হওয়া উচিত। সেটা হচ্ছে বলে আমরা মনে করি না।
আমরা একটি মানবিক বাংলাদেশ চাই যেখানে মান-সম্মান নিয়ে কোনো রকম জীবন যাপন করা যায়। এ রকম একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম ১৯৭১ সালে। সেই স্বপ্ন এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। স্বপ্ন হিসেবেই তা মনের মধ্যে এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। অন্তর্জ্বালায় মানুষ ভুগছে; কিন্তু পরিত্রাণের কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। শান্তি ও সুন্দর আগামীর জন্য দেশের ১৬ কোটি মানুষ অপেক্ষা করছে।
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক
harunrashidar@gmail.com