রাসূল সা.-এর অনুসরণেরই মুক্তি

0
1327
blank
blank

অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান: রাসূলুল্লাহ সা: ছিলেন আখেরি এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল। তাঁর পূর্বে পৃথিবীতে মহান স্রষ্টা আরো অনেক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন বিশেষ কাল-অঞ্চল ও জাতি বা গোত্রের জন্য; কিন্তু আখেরি নবীকে মহান আল্লাহ্ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সমগ্র মানবজাতির জন্য পাঠিয়েছেন। তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে পূর্ণতা দান করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ সা:-এর মাধ্যমে সে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়িত করেছেন। দীর্ঘ সংগ্রাম, সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দুঃসহ জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে তিনি দ্বীন ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর সমগ্র জীবন ছিল মানবজাতির জন্য এক উজ্জ্বল অনন্য আদর্শ। ব্যক্তিগত জীবন থেকে তাঁর সামগ্রিক জীবন প্রণালি শুধু মুসলিম নয়, ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-অঞ্চল নির্বিশেষে সবার জন্যই হতে পারে অনুসরণীয় এবং একমাত্র কল্যাণকর আদর্শ। যদি বর্তমান বিশ্বের মানুষ তার এ মহান ও অতুলনীয় জীবনযাপন প্রণালি অনুসরণের চেষ্টা করেন, তাহলে অবশ্যই মানবসমাজে অবারিত শান্তি-কল্যাণ ও স্বস্তি-স্বাচ্ছন্দ্য নেমে আসবে।

রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সাদাসিধা। তিনি কখনো বিলাসিতার প্রশ্রয় দেননি। এতিম হিসেবে জন্মগ্রহণের পর তিনি দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর্যন্ত দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করে জীবনযাপন করেছেন। পঁচিশ বছর বয়সে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী খাদিজার রা: পাণি গ্রহণ করে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়ার পরেও তাঁর সাধারণ জীবনধারায় এতটুকু পরিবর্তন ঘটেনি। মক্কায় ইসলাম প্রচার শুরু করার পর বিধর্মী কুরাইশদের অত্যাচারে তিনি যে দুঃসহ, কষ্টময় জীবনযাপন করেছেন, মদিনায় হিজরতের পর একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ক হওয়ার পরেও তাঁর জীবনধারায় কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি এমনকি, মক্কা-বিজয়ের পর সমগ্র আরবের একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার পর সমগ্র বিশ্বে যখন তাঁর দূতেরা ইসলামের দাওয়াত নিয়ে ছুটে যান এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে মূল্যবান উপঢৌকনাদি তাঁর সামনে পেশ করা হয়, গণিমাতের মাল হিসেবে যখন তাঁর সামনে বিপুল সম্পদের স্তূপ জমা হয়, তখনো তিনি নিতান্ত নিঃস্ব ও সহায়-সম্বলহীন দরিদ্র মানুষের মতো সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। দুনিয়া ও আখিরাতে যিনি মানবজাতির অবিসংবাদী মহান নেতা, দুনিয়ার ধন-সম্পদ ও বিলাসিতা ছিল তাঁর কাছে নিতান্তই তুচ্ছ। তাঁর জীবনযাপন প্রণালি সম্পর্কে কয়েকটি সহিহ হাদিস :
‘তাঁর ব্যবহৃত কম্বল ছিল অনেক তালিযুক্ত’ (তিরমিজি শরিফ)।
‘তাঁর ব্যবহৃত কাপড়ের সংখ্যা ছিল অতি অল্প; কিন্তু তিনি সেগুলো অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতেন’ (বুখারি শরিফ)।
অন্যদেরও তিনি সাধারণ কিন্তু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরার উপদেশ দিতেন। একবার তিনি কোনো এক ব্যক্তিকে ময়লাযুক্ত কাপড় পরতে দেখে মন্তব্য করলেন : ‘সে কেন এগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে না’? আরেকবার অন্য এক ব্যক্তিকে ময়লাযুক্ত পোশাক পরা দেখে তার আর্থিক সঙ্গতির বিষয় জানতে চাইলেন। তার ভালো অবস্থার কথা জেনে বললেন : ‘আল্লাহ যেখানে তোমাকে এতটা নিয়ামত দান করেছেন, তখন তোমার পোশাক-আশাকে সে নিয়ামতের প্রতিফলন ঘটা উচিত’ (আবু দাউদ শরিফ)।
মহানবী সা:-এর সুবিখ্যাত বাণী, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।’
মহানবী সা: যে ঘরে বসবাস করতেন তা ছিল একটি সাধারণ পর্ণ-কুটির। তার চার দিকের দেয়াল ছিল মাটি দিয়ে তৈরী এবং ছাদ ছিল খেজুর পাতার। বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য ছাদকে উটের চামড়া দিয়ে ঢেকে দেয়া হতো। ওই একই উপাদানে নির্মিত ছিল উম্মুল মু’মিনিনের আলাদা আলাদা ছোট ছোট কামরা। তাঁর নিজস্ব কামরার সামগ্রী বলতে ছিল রজ্জু-নির্মিত একটি শোবার খাটিয়া, খেজুর পাতা দিয়ে তৈরী একটি বালিশ, পশুর চামড়ার মাদুর, একটি চর্ম-নির্মিত পানির পাত্র ও কিছু অস্ত্রশস্ত্র। পার্থিব সামগ্রী বলতে তাঁর এগুলো ছাড়া আর যা ছিল তা হলো : একটি উট, একটি ঘোড়া, একটি গাধা এবং শেষ জীবনে অর্জিত এক খণ্ড জমি (বুখারি, মুসলিম ও আবু দাউদ শরিফ)।
কোনো একদিন কিছু সাহাবি মহানবী সা:-এর শরীরে শক্ত মাদুরের দাগ বসে যাওয়া দেখে তাঁকে একটি নরম বিছানা দেয়ার অনুমতি চাইলে তিনি সবিনয়ে সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলেন : ‘দুনিয়ার সামগ্রী দিয়ে আমি কী করব? দুনিয়ার সাথে আমার সম্পর্ক সেই মুসাফিরের ন্যায়, যে পথ-চলাকালে সামান্য সময়ের জন্য বৃক্ষের ছায়ায় আশ্রয় নেয় তারপর আবার চলতে শুরু করে’ (তিরমিজি শরিফ)।
তিনি সবাইকে সাদাসিধা জীবনযাপনের উপদেশ দিতেন এবং নিজেও তা কঠোরভাবে পালন করতেন। তাঁর জীবনে বিলাসিতা বলতে কিছু ছিল না। একান্ত অনাড়ম্বর, সাধারণ জীবনই ছিল তাঁর পূত-পবিত্র জীবনের আদর্শ। এমনকি, যখন তিনি সমগ্র আরব এলাকার একচ্ছত্র মহান অধিপতি হন, তখনো অনেক সময় তিনি দিনের পর দিন না খেয়ে পেটে পাথর বেঁধে নিদারুণ কষ্টকর জীবন অতিবাহিত করেছেন। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা: বলেন, ‘এমন দিন তাঁর জীবনে কমই এসেছে যেদিন তিনি দুই বেলা খাবার খেতে পেরেছেন। তাঁর ইন্তেকালের সময় তাঁর গৃহে সামান্য কিছু যবের ছাতু ছাড়া আর কোনো সামগ্রীই ছিল না, আর সে যবের ছাতুও তিনি ক্রয় করেছিলেন জনৈক ইহুদির কাছ থেকে তাঁর যুদ্ধাস্ত্র বন্ধক রেখে প্রাপ্ত অর্থ থেকে’ (বুখারি ও মুসলিম শরিফ)।
একদিন মহানবী সা: মদিনার মসজিদে নামাজে ইমামতি করছিলেন। নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে তিনি দাঁড়ালেন। মুসল্লিদের কাতার পাড়ি দিয়ে তিনি দ্রুতগতিতে তাঁর কামরায় প্রবেশ করলেন। তাঁর এ ব্যস্ততা দেখে সমবেত সবাই বিস্মিত হলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে তিনি কৈফিয়ত হিসেবে বললেন, ‘আমার হঠাৎ স্মরণ হলো আমার নিকট সদ্কার একটি রৌপ্য (অথবা স্বর্ণের) মুদ্রা গচ্ছিল রয়েছে। এতে আমার দারুণ অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। তাই আমি গিয়ে ওটা বিতরণের ব্যবস্থা করে এলাম’ (বুখারি শরিফ)।
দুনিয়ার ধন-সম্পদ ও সুখ-শান্তির প্রতি এমনই নিস্পৃহ ছিলেন তিনি। তাই বিশাল ধনভাণ্ডার ও বিপুল ঐশ্বর্যরাজি তাঁর হস্তগত হওয়া সত্ত্বেও তিনি তা অকাতরে সবার মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে নিজে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহার-অর্ধহারে, নিরাভরণ ও কৃচ্ছ্রতাপূর্ণ জীবনযাপন করেছেন।
উন্মুল মুমিনিন আয়িশা রা: বর্ণিত অন্য একটি হাদিস : ‘আমরা একটা নতুন চাঁদ দেখতাম, তারপর আর একটা নতুন চাঁদ দেখতাম, তারপর আর একটা নতুন চাঁদ দেখতাম, এভাবে দুই মাসে তিনটা নতুন চাঁদ দেখে ফেলতাম অথচ এ দীর্ঘ সময়ে রাসূলুল্লাহ সা:-এর কোনো ঘরেই আগুন জ্বলত না।’ তাহলে আপনারা জীবনযাপন করতেন কিভাবে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুটি কালো বস্তু-খেজুর খেয়ে ও পানি পান করে জীবন ধারণ করতাম। তবে হ্যাঁ, রাসূলুল্লাহ সা:-এর কয়েকজন আনসার প্রতিবেশী ছিলেন। তাঁদের কাছে দুগ্ধবতী উটনী ছিল। তাঁরা রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে কিছু দুধ পাঠাতেন। আর তিনি তা আমাদের পান করাতেন’ (বুখারি ও মুসলিম শরিফ)।
আনাস রা: বলেন : একবার ফাতিমা রা: এক টুকরো রুটি নিয়ে রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে এলেন। রাসূলুল্লাহ সা: তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা কিসের টুকরো?’ নবী-কন্যা ফাতিমা রা: জবাব দিলেন, ‘এটা রুটির টুকরো। আপনাকে না দিয়ে আমি টুকরোটি একা খাই তা আমার মন চাচ্ছিল না।’ মহানবী সা: বললেন, ‘তোমার পিতার মুখে তিন দিন পর এ প্রথমবার এটুকু খাদ্য প্রবেশ করছে।’
একবার মহানবী সা:-এর কাছে ফিরিশতা জিবরাইল আ: হাজির হয়ে আরজ করলেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! মহান আল্লাহ আপনাকে সালাম দিয়ে বলেছেন- আমার হাবিবকে বলো, যদি তিনি ধন-সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, তবে ওহুদ পাহাড়কে সোনায় পরিণত করা হবে এবং তিনি যেখানে যাবেন, সোনার এ পাহাড়টিও তাঁর অনুবর্তী হবে। জবাবে মহানবী সা: বললেন : আমি ধন-সম্পদ চাই না, আমি একদিন খেয়ে মহান আল্লাহর শোকর আদায় করতে চাই এবং অন্য দিন না খেয়ে সবর ইখতিয়ার করতে চাই।
এই ছিল মহানবী সা:-এর জীবনযাপন পদ্ধতি এবং জাগতিক জীবন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি নিজে অতিশয় সাদাসিধা জীবনযাপন করতেন এবং অন্যদেরও এরূপ সাধারণ জীবনযাপনে উৎসাহ দিতেন। অথচ ইহকাল-পরকাল উভয় দুনিয়ার তিনি ছিলেন সর্দার-মানবজাতির উজ্জ্বল মুকুট। সমগ্র আরব জাহান যখন তাঁর করতলগত হয় এবং তৎকালীন বিশ্বের দুই মহাপরাক্রান্ত শক্তি- রোমক ও পারস্য সাম্রাজ্য যখন ইসলামের অগ্রাভিযানের সামনে তাসের ঘরের মতো বিলীন হয়ে পড়ে তখন প্রকৃতপক্ষে সমগ্র বিশ্বেই মহানবী সা:-এর একচ্ছত্র প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে।
পারস্য ও রোমক সাম্রাজ্যদ্বয়ের যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ধনৈশ্বর্য এবং বিলাস-ব্যসন তাঁর পদতলে গড়াগড়ি যায়। তিনি চাইলে দুনিয়ার যেকোনো পরিমাণ ধন-সম্পদ অর্জন ও তা ভোগ করতে পারতেন। কিন্তু দুনিয়া এবং দুনিয়ার সব উপভোগ সামগ্রীর ব্যাপারে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নিস্পৃহ। তিনি দুনিয়ার প্রতি মোহমুক্ত থেকে সমগ্র মানবজাতির সামনে এক তুলনাহীন সমুজ্জ্বল আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। এ সম্পর্কে তাঁর অমর বাণী :
‘দুনিয়ার এ ক্ষণভঙ্গুর জীবনের জন্য এ পরিমাণ কাজ করো, যে পরিমাণ সময় তুমি দুনিয়ায় বসবাস করবে, আর আখিরাতের জন্য এ পরিমাণ কাজ করো, যে পরিমাণ সময় তুমি সেখানে অবস্থান করবে।’
লেখক : শিক্ষাবিদ