রিটার্ন জমা না দিলে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বন্ধ

0
1154
blank
blank

ঢাকা: এবার বাজেটে ১০ম গ্রেড পর্যন্ত সরকারি চাকরিজীবীদের রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রিটার্ন দাখিল নিশ্চিত করতে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেটি হচ্ছে, চলতি করবর্ষে আয়কর রিটার্ন জমা না দিলে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বন্ধ হয়ে যাবে। এটি কার্যকর হবে জানুয়ারি থেকে। এর ফলে নতুন ৪ লাখ সরকারি চাকরিজীবী করের আওতায় আসবে বলে মনে করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
৩০ নভেম্বরের মধ্যে যেসব সরকারি চাকরিজীবী রিটার্ন জমা দেননি বা সময় বৃদ্ধির আবেদন করেননি তাদের বেতন বন্ধের সুপারিশ করে সম্প্রতি এনবিআর হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের (সিজিএ) কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মূল বেতন ১৬ হাজার বা তার বেশি হলে ওই কর্মচারীর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রতি মাসের বেতন বিলের সঙ্গে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার প্রমাণপত্র সংযুক্ত করতে হবে। অথবা রিটার্ন দাখিল না করে সময় বৃদ্ধির আবেদন করে থাকলে উপ-কর কমিশনারের অনুমোদিত আবেদনপত্রের কপি বেতন বিলের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। বেতন পরিশোধের আগে বিলের সঙ্গে এসব কাগজপত্র জমা দেয়া হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে বেতন পরিশোধের সুপারিশ করা হয় চিঠিতে।
এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, সরকারি চাকরিজীবীদের রিটার্ন দাখিল আগে থেকেই বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু অনেকে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। তাই এবার বাজেটে মাসিক বেতন ১৬ হাজার টাকা সিলিং করে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বেতন বিলের সঙ্গে আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র জমা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। মূলত রিটার্ন জমা নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর ফলে প্রায় নতুন ৪ লাখ সরকারি চাকরিজীবী করের আওতায় আসবেন। এতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রিটার্ন দাখিলের সংস্কৃতি তৈরি হবে।
তবে সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মাসিক মূল বেতন ১৬ হাজার টাকা হলে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হলেও ট্যাক্স দিতে হবে না। কারণ এই শ্রেণীর কর্মচারীদের বার্ষিক মূল বেতন ও দুটি উৎসব ভাতা মিলে বছরে মূল আয় আড়াই লাখ টাকার কম, যা করমুক্ত আয়ের সীমার নীচে। ইনক্রিমেন্ট যুক্ত হয়ে মূল বেতন ১৭ হাজার ৮৫৭ টাকা অতিক্রম করলে ন্যূনতম আয়কর দিতে হবে। তবে কর্মচারীদের বেতন ছাড়াও অন্যান্য আয় বা ব্যাংক সুদ থাকলে হিসাব করে তাদের আয়কর দিতে হবে।
এর আগে এনবিআর চেয়ারম্যান সরকারি কর্মচারীদের কাছ থেকে আয়কর আদায় নিশ্চিত করতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব, সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের চিঠি দেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, বেতন খাতে প্রাপ্ত আয়ের ওপর আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ধারা ৫০ অনুযায়ী উৎসে কর কর্তনের বিধান রয়েছে, যা সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নতুন বেতন স্কেলে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হয়েছে। এজন্য সব করযোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছ থেকে উৎসে কর কর্তন নিশ্চিত করার তাগিদ দেন চিঠিতে।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্র্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এ সিদ্ধান্তের ফলে সরকারি চাকরিজীবী করদাতার সংখ্যা বাড়বে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এ পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। ১৬ হাজার টাকার বেশি বেতন হলে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র জমা নেয়া উচিত। এ পদ্ধতি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে করদাতার সংখ্যা ৫০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে করবৈষম্য থাকা উচিত নয়। সবার ক্ষেত্রে মোট আয়ের ওপর ট্যাক্স ধার্য করা উচিত। বিদেশে রেস্টুরেন্টের কর্মীরা বখশিশ পেলেও ওই আয় থেকে ট্যাক্স কেটে রাখা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে কিছু ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিজীবীদের ছাড় দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, ঢাকায় কর্মরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর অঞ্চল-৪ এর অধিক্ষেত্রভুক্ত করদাতা। এই কর অঞ্চল থেকে কোন গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মাসিক কত টাকা বেতনের বিপরীতে উৎসে কর হিসাবে কেটে রাখতে হবে তার একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। প্রাপ্ত তালিকা অনুযায়ী, ১০ গ্রেডের কর্মচারীদের বেতন থেকে ৪১৬ টাকা উৎসে কর হিসাবে কেটে রাখতে হবে। ইনক্রিমেন্ট পেয়ে বেতন সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছলে কর্মচারীদের ৭৩৪ টাকা কর দিতে হবে। একইভাবে ৯ম গ্রেডের ৪১৬ থেকে শুরু করে ২ হাজার ১৭২ টাকা, ৮ম গ্রেডে ৪১৬ থেকে ২ হাজার ৪৮৮ টাকা, ৭ম গ্রেডে ৪১৬ থেকে ৩ হাজার ৫৩০ টাকা, ৬ষ্ঠ গ্রেডে ৫০৫ থেকে ৪ হাজার ৩ টাকা, ৫ম গ্রেডে ১ হাজার ৫২ থেকে ৪ হাজার ৩৭৬ টাকা, ৪র্থ গ্রেডে ১ হাজার ৭৭০ থেকে ৪ হাজার ৫৫৩ টাকা, ৩য় গ্রেডে ২ হাজার ৬২৩ থেকে ৪ হাজার ৯৯৯ টাকা, দ্বিতীয় গ্রেডে ৩ হাজার ৮৭০ থেকে ৫ হাজার ২৯১ টাকা এবং প্রথম গ্রেডের কর্মকর্তাদের মাসিক ৫ হাজার ৫০৩ টাকা কর দিতে হবে। তবে যদি কারও কর রেয়াতযোগ্য খাত যেমন সঞ্চয়পত্র, জীবন বিমার প্রিমিয়াম, প্রভিডেন্ট ফান্ডে বিনিয়োগ থাকে তাহলে ওইসব কর্মচারীকে কম কর দিতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অন্য নাগরিকদের মতো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ট্যাক্স দেয়া উচিত। এনবিআরের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এতে কর ভিত্তি ও কর আদায় দুটোই বাড়বে। পাশাপাশি শৃংখলা আসবে। তবে কর্পোরেট ও ব্যক্তি খাতকে একইভাবে করের আওতায় আনতে হবে। রিটার্ন জমা দিতে বাধ্য করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, করদাতারা যাতে হয়রানির শিকার না হন সে জন্য এনবিআরকে ডিজিটালাইজড করতে হবে। পাশাপাশি অনলাইনে রিটার্ন জমা এবং ট্যাক্স ক্যালকুলেটর আরও একটু সহজ করতে হবে। তাহলে করদাতার সংখ্যা বাড়বে।