রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কোথায়?

0
923
blank
blank

রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য একটি গভীরতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের পর সমস্যাটি যে এতটা জটিল হয়ে উঠবে, তা অনেকের ভাবনায়ও ছিল না। উপরন্তু এর কিছুদিন পরই বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়, যার ফলে মনে হয়েছিল দুই দেশের সমঝোতার মাধ্যমে কোনো ধরনের সংকট ছাড়াই বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাবে এবং সমস্যাটি দীর্ঘায়িত হবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমরা এই সমঝোতার কোনো বাস্তবিক প্রয়োগ দেখতে পাইনি।

এর পরিপ্রেক্ষিতে এই সংকটের একটি স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সেখানে তিনি ধর্ম ও গোত্রনির্বিশেষে মিয়ানমারে বসবাসরত সব বেসামরিক লোকজনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি ‘নিরাপদ এলাকা’ তৈরির কথা বলেন। এ ছাড়া তিনি মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত সব রোহিঙ্গাকে নিজ দেশে নিরাপদে ফেরার নিশ্চয়তা প্রদানের কথা বলেন। এরই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের লক্ষ্যে চার দফা প্রস্তাব পেশ করেন, যেখানে তিনি টেকসই প্রত্যাবাসনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। এ ছাড়া তিনি মিয়ানমারের প্রতি রোহিঙ্গাদের আস্থা তৈরি করা এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের রাখাইনে সফরের আয়োজন করার কথা বলেন। পাশাপাশি তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা এবং এই সংকটের কারণ বিবেচনায় রেখে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে বলেন। ইতিমধ্যে ২০১৮ সালের নভেম্বরে এবং ২০১৯ সালের আগস্টে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ দুবারই ব্যর্থ হয়। এর ফলে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে জনমনে ব্যাপক সংশয় তৈরি হয়। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গাদের শিবিরের মধ্যে বিশাল সমাবেশ নানা রকম প্রভাব তৈরি করেছে।

এদিকে, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ অবস্থানের ফলে নানা রকম আর্থসামাজিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি দীর্ঘায়িত হওয়ায় শিবিরে রোহিঙ্গাদের দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা ও বঞ্চনা বেড়ে চলেছে। রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে বৈষয়িক টানাপোড়েন ও মানসিক দূরত্ব বাড়ছে। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতির কারণে স্থানীয় পর্যায়ে জনসংখ্যাগত যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে পারস্পরিক অসন্তোষ, সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। তা ছাড়া, রোহিঙ্গাদের নানা রকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতাও ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করা, বাংলাদেশের পাসপোর্ট তৈরি করা, এমনকি ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তিকরণের তৎপরতায় তাদের লিপ্ত হওয়ার খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আসছে। এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর একটি আবদ্ধ স্থানে কর্মহীন অবস্থায় বসবাস করার কারণে তাদের মধ্যে একধরনের হতাশাও লক্ষ করা যাচ্ছে। অধিকন্তু রোহিঙ্গাদের অবস্থান আরও দীর্ঘায়িত হলে তা বাংলাদেশের জন্য একটি নিরাপত্তাঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।

এসব কারণে রোহিঙ্গা সমস্যাটি এখন বাংলাদেশের জন্য একটি বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রোহিঙ্গা সংকট: চ্যালেঞ্জ এবং টেকসই সমাধান’ শিরোনামে দুই দিনব্যাপী একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রসচিবসহ দেশি-বিদেশি প্রায় ১৫০ জন গবেষক, শিক্ষাবিদ ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গা সমস্যার নানা দিক নিয়ে বিচার–বিশ্লেষণ করেন এবং এই সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন।

সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সবাই এ ব্যাপারে একমত যে নিরাপদ প্রত্যাবর্তনই রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র স্থায়ী সমাধান। এত বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর ভরণপোষণের ভার বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল ও উন্নয়নশীল দেশ অনির্দিষ্টকালের জন্য বহন করবে, তা প্রত্যাশা করা যায় না। এ বিষয়টি সামনে রেখেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন বিষয়ে কতগুলো ব্যবস্থার কথা সম্মেলনে বারবার বলা হয়। এগুলো হলো: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রদত্ত পাঁচ দফার আলোকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান খোঁজা; মিয়ানমারের ওপর চাপ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশের বৈদেশিক মিশনগুলোর প্রচার কার্যক্রম বেগবান করা; স্থায়ী, সফল এবং স্বেচ্ছা প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গাদের যৌক্তিক দাবি বিবেচনায় নেওয়া; এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ও উপ–আঞ্চলিক সংস্থা, যেমন সার্ক, আসিয়ান, বিমসটেক এবং ওআইসিকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে প্রভাবিত করা। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের শান্তি ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে জাতিসংঘের নিশ্চয়তা প্রদানকারীর ভূমিকা পালন নিশ্চিত করা। প্রত্যাবর্তন না হওয়া পর্যন্ত কিছু অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার কথাও আলোচনায় আসে, যেমন ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মানব পাচার রোধ করা, ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে তাদের উৎসাহিত করা, দুর্যোগের ঝুঁকি কমাতে রোহিঙ্গাদের প্রস্তুত করা, সব রোহিঙ্গার জন্য আইডি কার্ডের বিধান করা এবং পরিবেশ পুনরুদ্ধার করা। রোহিঙ্গাদের এসব সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ করার কথাও এই সম্মেলনে আলোচিত হয়, যাতে করে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো ধরনের টানাপোড়েন তৈরি না হয়।

আবার এটিও মনে রাখা প্রয়োজন যে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। কেননা, একদিকে মিয়ানমার মানবাধিকার–সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণা ও সনদগুলোকে ক্রমাগত অস্বীকার করে চলেছে; অন্যদিকে প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের গণহত্যা থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কনভেনশনের বাস্তবিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আঞ্চলিক প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থাগুলো তাদের ভূ-কৌশলের বিষয়গুলোকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। এদিকে মিয়ানমারের ক্রমাগত অসহযোগিতার কারণেও বাংলাদেশের একার পক্ষে এই সংকটের সমাধান বের করা সম্ভব নয়।

তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়েই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারকে এগিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলো নেওয়ার মাধ্যমে এই সংকটের একটি সমাধানের দিকে আমরা যেতে পারি: প্রথমত, মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে বৈশ্বিক ঐকমত্য সৃষ্টির প্রয়াস চলমান রাখা। দ্বিতীয়ত, আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য প্রভাবশালী দেশগুলো যেন মিয়ানমারকে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে, সে লক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। তৃতীয়ত, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের জন্য আসিয়ান এবং ওআইসির উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে ধারাবাহিকভাবে সংলাপ শুরু করার জন্য বাংলাদেশকে উদ্যোগ নিতে হবে। এ লক্ষ্যে ঢাকায় কিংবা এসব দেশের রাজধানীগুলোতে ধারাবাহিক বৈঠক হতে পারে। চতুর্থত, দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় সংলাপে, আলোচনা ও মতৈক্যের বিষয়গুলোতে রোহিঙ্গাদের যৌক্তিক দাবিদাওয়াকে (যেমন তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের স্বীকৃতি, নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার, জমি ফিরে পাওয়া এবং প্রত্যাবাসনের পর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ইত্যাদি) গুরুত্ব দিতে হবে, যেন স্বেচ্ছা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া কার্যকর হয়।

সবশেষে এ কথা বলা যায় যে ১৯৪৮ সালে স্বাক্ষরিত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র এবং ২০০৫ সালের ‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট’ (R2P) বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তথা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ তাদের বাধ্যবাধকতা অস্বীকার করতে পারে না। সুতরাং জাতিসংঘকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। সেই সঙ্গে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের পর অন্ততপক্ষে প্রথম তিন বছর পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে রাখতে হবে।

লেখক: বুলবুল সিদ্দিকী, এম জসিম উদ্দিন, মো. মাহমুদুর রহমান ভূঞা, ইশরাত সুলতানা (নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক)