লন্ডন ষড়যন্ত্র!

0
876
blank
blank

ড. আবদুল লতিফ মাসুম:

এক
ষট্+যন্ত্র=ষড়যন্ত্র, অর্থ হচ্ছে ছ’টি বা অনেক যন্ত্র দিয়ে জটলা পাকানো। এর ভাবার্থ হচ্ছে, কোনো কিছুকে জটিল ও কুটিলভাবে চিন্তা করা। বাস্তবে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি সবারই জানা কথা। আগেকার দিনে সাধারণ মানুষের মধ্যে ষড়যন্ত্রের লালন-পালন ও বাস্তবায়ন থাকলেও এর মূল কেন্দ্রিকতা ছিল রাজা-রাজ্য-রাজধানী। হাজার বছর ধরে পৃথিবীর মানুষের অনেক কিছুতে পরিবর্তন হলেও মৌলিক স্বভাব-চরিত্র বদলায়নি এতটুকু। আজো ষড়যন্ত্র চলছে আগের মতোই। আগের রাজা-রাজ্য এবং রাজন্য একটি শব্দে একীভূত হয়েছে আর তা হচ্ছে ‘রাজনীতি’। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও বসে নেই। তারা রীতিমতো তত্ত্বকথার আলোকে ‘ষড়যন্ত্র’কে আনুষ্ঠানিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে ব্যতিব্যস্ত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাইকেল বার্কুনের মতে, গোটা বিশ্বই একটি নেতিবাচক নীলনকশা দিয়ে পরিচালিত। তিনি ব্যাখ্যা করেন, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তিনটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে গ্রোথিত। প্রথমত, কোনো কিছুই সাধারণভাবে ঘটে না। দ্বিতীয়ত, যা দেখছেন তা আসল নয়। তৃতীয়ত, সব কিছুর সাথে সব কিছু সম্পর্কিত। তিনি আরো বলেন, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সব কিছুকে ষড়যন্ত্রমূলক বলেই ধারণ করে। তিনি বিষয়টিকে প্রবাদের মতো করে উপস্থাপন করেন : A matter of faith rather than proof। বার্কুন ২০০৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত তার বিখ্যাত A Culture of Conspiracy : Apocalyptic Visions in Contemporary America বইয়ে এসব তত্ত্বকথা বলেন। তিনি যখন প্রমাণ ছাড়াই শুধু বিশ্বাস বা ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করেন, তখন বিষয়টি আসলে দাঁড়ায় ‘মনে মনে কলা খাওয়ার মতো’। তাহলে যড়যন্ত্র তত্ত্ব হচ্ছে, অনুমাননির্ভর বা হাইপোথেসিস। গবেষণা ক্ষেত্রে আমরা একটি প্রাক-অনুমান দিয়ে শুরু করি। এর সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে মাঠ পর্যায়ে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণা শেষ করি। পক্ষান্তরে, ষড়যন্ত্রতত্ত্বে শুরু এবং শেষ সবই অনুমাননির্ভর। এ তত্ত্বকথায় বলা হয়, দুই বা ততোধিক লোক অথবা কোনো সংগঠন যদি গোপন পরিকল্পনার ভিত্তিতে উদ্দেশ্যমূলক অন্যের ক্ষতি করার প্রয়াস নেয়, তাহলে তা ‘ষড়যন্ত্র’ পদবাচ্য হবে। ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উৎস হচ্ছে সন্দেহ, অবিশ্বাস এবং নেতিবাচক মানসিকতা। ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্ব হচ্ছে প্রচলিত আইনকানুন, রীতি-রেওয়াজ এবং সভ্যতা-ভব্যতাবিরোধী বিষয়াবলি। এ তত্ত্বে একটি সহজ বিষয়কে জটিল-কুটিল করে ব্যাখ্যা করা হয়। মানুষ সহজেই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মাধ্যমে ক্ষমতার ওঠানামাকে ব্যাখ্যা করে। পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার জন্য আজো কাশিমবাজার কুঠির ষড়যন্ত্রের কথা বলা হয়। রাজনীতিকেরা একে অপরকে কাশিমবাজার কুঠির ষড়যন্ত্রকারী বলে দোষারোপ করেন। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে ক্ষমতার সঙ্ঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে। কখনো কখনো ব্যক্তি, দল এবং গোষ্ঠী ষড়যন্ত্রতত্ত্বের পক্ষ এবং প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।

দুই
বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা যেখানে-সেখানে ষড়যন্ত্রের কথা বলেন।এই সেদিন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রধানমন্ত্রীর সাহসী ঘোষণায় লন্ডন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। তাই বিএনপি এখন নিদারুণ হতাশ। তিনি ১৩ এপ্রিল দুপুরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভুলতা এলাকায় ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, একটি মহল কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার অপচেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সময়োপযোগী ঘোষণা দিয়েছেন। তার ঘোষণায় কোটা আন্দোলন নিয়ে লন্ডনের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। কোটার বিষয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে বাতিল করাই ছিল সময়োপযোগী পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এজন্য কেবিনেট সেক্রেটারির নেতৃত্বে একটি কমিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে বলেও জানান তিনি (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৪ এপ্রিল ২০১৮)। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অবশ্য এ সময় ‘লন্ডন ষড়যন্ত্র’ বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন তা খোলাসা করেননি। পরবর্তী সময়ও তিনি এ বিষয়ে আরো কোনো ব্যাখ্যা দিয়েছেন বলে জানা যায়নি। তবে তিনি যদি কোটা আন্দোলন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর মামুনকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের টেলিফোন সংলাপকে বুঝিয়ে থাকেন তাহলে তা একটি ভোকাল পয়েন্ট হতে পারে। অবশ্য সেটি ষড়যন্ত্রমূলক সংলাপ কি না, সেটি বিবেচ্য বিষয়। পাঠক সাধারণের জানার জন্য সেই সংলাপটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

-জ্বি মামুন সাহেব বলছেন? জ্বি বলছি। আমার নাম তারেক রহমান। আসসালামু আলাইকুম, ভালো আছেন?
ড. মামুন আহমেদ : আসসালামু আলাইকুম, জ্বি আমি ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?
তারেক রহমান : আছি আলহামদুলিল্লাহ মোটামুটি।
ড. মামুন আহমেদ : আপনার শরীর কেমন?
তারেক রহমান : শরীরও আছে মোটামুটি। আমি ফোন করলাম এই যে ছেলেপেলেরা যে এই কোটা বাতিলের জন্য বা সংস্কারের জন্য যে আন্দোলন করছে …।
ড. মামুন আহমেদ : জ্বি
তারেক রহমান : দাবিটা তো জেনুইন। দেশের অধিকাংশ স্টুডেন্ট যারা মেধাবী বলে স্বীকৃত তারা অধিকাংশই তো মনে হয় এটির সাথেই আছে তাই না এবং আমার মনে হয় সাধারণ মানুষও আছে। কারণ এই কোটা পদ্ধতিটাকে গত কয়েক বছরে বলা যায় আওয়ামী লীগ নষ্ট করে দিয়েছে। আমার মনে হয় এই দাবিটা ন্যায্য দাবি। তো এখন থেকে যারা আছেন সাদা দলের বিশেষ করে আমাদের মনা যারা, তারা এটাকে একটু অর্গানাইজ করে এদের একটু সাপোর্ট দিলে হয় না!
ড. মামুন আহমেদ : আমার ব্যক্তিগত ধারণা সাপোর্টটি দেয়া প্রয়োজন।
তারেক রহমান : প্রয়োজন?
ড. মামুন আহমেদ : হ্যাঁ প্রয়োজন। অর্গানাইজ ওয়েতেই সেটি করা প্রয়োজন। তবে অর্গানাইজ করাটা বিভিন্ন কারণে সম্ভব হয়নি। তবে এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে আসলে অর্গানাইজ সময় হয়ে এসেছে। আমি শিওর যে আপনি বলাতে এটা আরো বেশি এক্সপাডাইট হবে নিশ্চয়। নিশ্চয় আমরা সেটা করব।
তারেক রহমান : তাহলে আপনাদেরকে একটু দায়িত্ব নিতে হবে। দায়িত্ব নিয়ে তো এই জিনিসটা করতে হবে। তো আপনি একটু এগিয়ে আসেন তাহলে। আপনি কথা বলেন সবার সাথে তাহলে। যারা এখানে আছেন তাদের সাথে কথা বলে জিনিসটাকে একটু অর্গানাইজ করেন। আমি আর দু’একজনকে বলছি। আপনি একটু আপনার অবস্থান থেকে একটু ভূমিকা রাখেন। একটা ভূমিকা নেন আপনারা।
ড. মামুন আহমেদ: ডেফিনিটলি
তারেক রহমান : এই নম্বরটা সেভ করে রাখেন। আপনি আপডেটটা তাহলে এই নম্বরে দিতে পারবেন। এটা আমার নম্বর। অন্য কোনো বিষয়ে প্রয়োজন হলেও আমার সাথে আলাপ করতে পারবেন।
ড. মামুন আহমেদ : আমি তো বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। আর আমি শিক্ষক কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি। আপনি বোধহয় জানেন। দোয়া করবেন আমাদের জন্য। বিভিন্ন প্রয়োজনে আমি আপনার সাথে।
তারেক রহমান : আপনিও দোয়া করবেন। তো আই এম এক্সপেক্টিং অ্যা আপডেট ফ্রম ইউ টুমোরো।
ড. মামুন আহমেদ : ওকে। জ্বি অবশ্যই
তারেক রহমান : আগামীকাল আমি একটা আপডেট আশা করছি।
ড. মামুন আহমেদ : ওকে। ওকে। জ্বি। আসসালামু আলাইকুম।
তারেক রহমান : আসসালামু আলাইকুম।

গোটা সংলাপটি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলে কী বোঝা যায়? একজন রাজনৈতিক নেতার রাজনৈতিক বিষয় বা আন্দোলন সম্পর্কে আগ্রহ অন্যায় কিছু নয়। তারেক রহমান দেশের একটি শীর্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে কোটা আন্দোলন সম্পর্কে তার সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। ওই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি তার ঘরানার সমর্থনকে আরো ত্বরান্বিত করতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেখানে পেশা আর রাজনীতি একাকার সেখানে বিএনপির রাজনীতির প্রতি সহানুভূতিশীল কারো সাথে আলাপ করা রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিপরীত কিছু নয়। তবে আন্দোলনকে যদি তারেক রহমান রাজনৈতিক রূপ দিতে চাইতেন তা ন্যায় সঙ্গত হতো না। উদ্ধৃত সংলাপে আমরা সেরূপ কিছু লক্ষ করি না। ষড়যন্ত্রের যে কথা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বললেন, তার বাস্তবতা কোথায়? আন্দোলনকে যদি তারেক রহমান বিপথগামী অথবা সহিংস করার ইঙ্গিত দিতেন তাও ন্যায়সঙ্গত হতো না। কিন্তু শুধু এই সংলাপকে কেন্দ্র করে যদি ষড়যন্ত্রের উৎস সন্ধান করা হয় তাহলে সেটি অবশ্যই অন্যায় হবে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, অনেক বছর ধরে তারেক রহমান লন্ডনে প্রথমত চিকিৎসাধীন ছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি এখন রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন। রাজনৈতিক আশ্রয় মানে কোনো ব্যক্তি যদি তার দেশের সরকার বা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক রাজনৈতিক নিপীড়ন ও প্রতিহিংসার মুখোমুখি হন, তাহলে তিনি অন্য দেশে তার জীবন, সম্মান ও সম্পদ সুরক্ষার জন্য আশ্রয় চাইতে পারেন। লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে’র কাছে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে যুক্তরাজ্য শাখা আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে তারেক রহমানকে দেশে এনে জেলে ঢোকানো বা নিঃশেষ করার প্রয়াস বিগত সময়ে লক্ষ করা গেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার উল্লেখ করে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য থেকে তারেক রহমানকে বাংলাদেশ কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার হাতে তুলে দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। শুধু তারেক রহমান কেন, মানবাধিকারের প্রশ্নে নিপীড়িত কোনো ব্যক্তিকেই যুক্তরাজ্য এভাবে অনিরাপদ করে কারো হাতে তুলে দেয় না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে যে, তিনি ওখান থেকে জঙ্গি রাজনীতি করছেন অথবা সন্ত্রাসের মদদ দিচ্ছেন। এ ধরনের কোনো অভিযোগই তার বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়নি। সাধারণ জ্ঞানে আমরা বুঝি তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকার সুবাদে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা পাবার অধিকারী। সেটির অন্য অর্থ যে তার কোনো কর্মতৎপরতার ব্রিটিশ নিরাপত্তা বলয়ের বাইরে নেই। সুতরাং তার নিয়ম-রীতির বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে একজন আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী নেতাকে শাস্তি দেয়ার ষড়যন্ত্র কারা করছে? এ প্রশ্নটি যথার্থভাবেই উত্থাপন করা যায়। তারেক রহমান একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। তার সাথে সবাই সব বিষয়ে একমত হবেন এটা স্বাভাবিক নয়। তাকে সমর্থন করার অথবা বিরোধিতা করা গণতন্ত্রের অধিকার, যা সবারই রয়েছে। কিন্তু বিগত ১০ বছরে তার প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে তা অমানবিক, অন্যায় এবং প্রতিহিংসামূলক। তার কথা মানুষ শুনতে পায় না। মানবাধিকারের দৃষ্টিতে তা কতটুকু যৌক্তিক?

এবার আসা যাক যে বিষয় নিয়ে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ সে সম্পর্কে। প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়ে সাধুবাদ পেয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ সাধুবাদের রেশ কাটতে না কাটতে আমরা অসাধু আচরণ দেখলাম। আন্দোলনের নেতাদের চোখ বেঁধে নেয়া হলো পুলিশ ডিবি কার্যালয়ে। তাদের সাথে অন্যায়, অশোভন আচরণ করা হলো। তাদের পরিবারকে রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হতে হলো। মিথ্যা রাজনৈতিক পরিচয় আরোপ করার অপচেষ্টা হলো। সরকারের ঠ্যাঙ্গারে বাহিনীর ভীতি বলয়ে অবস্থান করছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। এসবের নাম যদি ষড়যন্ত্র না হয় তাহলে ষড়যন্ত্র কাকে বলে? ঘোষণার পরবর্তী এসব আলামত দেখে সিভিল সোসাইটি, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকেরা আশা আশঙ্কার মধ্যে আছেন। তারা দেখছেন কোটা বাতিলের জটিলতা এখনো কাটেনি। প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্যও আনুষ্ঠানিক কমিটি হয়নি। চলমান নিয়োগ প্রক্রিয়া কিভাবে এগোবে তা স্পষ্ট নয়। সর্বত্র একটু ধোঁয়াশা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। আন্দোলনের সংগঠকেরা বলতে বাধ্য হচ্ছেন, দাবি মেনে নেয়ার চেয়ে আন্দোলন থামিয়ে দেয়া সরকারের অগ্রাধিকার ছিল। ষড়যন্ত্র চলছে আন্দোলনের প্রতিপক্ষ উসকে দেয়ার। একজন বিশিষ্ট কলামিস্ট সরকারের পদক্ষেপকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার ভাষায়, ‘আন্দোলনকারী ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে গোপন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে, অথচ এ সিদ্ধান্ত যে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রসূত সেটা সমর্থকেরা অস্বীকার করছেন না’ (প্রথম আলো, ১৩ এপ্রিল ২০১৮)। এর আগে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ খেতাব পেতে হয়েছে। পেটোয়া ছাত্র বাহিনীর নিগ্রহ এবং পুলিশ বাহিনীর নিপীড়ন ও গ্রেফতারের শিকার হতে হয়েছে আন্দোলনকারীদের। সুতরাং আন্দোলনের পূর্বাপর ষড়যন্ত্রকারী কারা? ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কথায় বলে যারা যেমন তারাই তেমন চিন্তা করে।

ষড়যন্ত্রকারীরা কেবল ষড়যন্ত্রই দেখে সর্বত্র।
কোনো কোনো তাত্ত্বিক একে মনস্তাত্ত্বিক বিষয় বলে বর্ণনা করেন। মনস্তত্ত্বের এসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে দৃশ্যমান বিষয়, ব্যক্তিগত মনোভঙ্গি এবং চিন্তার বৈকল্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্কুন ষড়যন্ত্রতত্ত্বের ওপর ব্যাপক গবেষণা করেছেন। অসম্ভব ক্ষমতাধারী, মারাত্মক কপট এবং রাজনৈতিক ধূর্ত এলিটরা এ তত্ত্বটির প্রয়োগ মাত্রাতিরিক্তভাবে করে থাকেন। হ্যারি জি. ওয়েস্ট ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কার্যকারিতার তিনটি উপায় বর্ণনা করেন- ০১. ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মাধ্যমে যা করা সম্ভব প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তা করা সম্ভব নয়। তারা এমনভাবে ষড়যন্ত্র কার্যকর করে, যা প্রচলিত নিয়মরীতি এবং গতানুগতিকতার কাছে আকস্মিক। ০২. তারা কাজটি করে আবেগ এবং প্রতারণার সংমিশ্রণে। এরা সচেতনভাবে আলোকে অন্ধকার এবং অন্ধকারকে আলো বানিয়ে ফেলে। তারা তাদের কৌশলগত কাজগুলো এককভাবে এবং একক এজেন্টদের দিয়ে সম্পন্ন করে। ০৩. তারা যথেষ্ট প্রতারণার সাথে বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন করে যে, তার মধ্যে অভিনবত্ব রয়েছে। তারা বিষয়টিকে অতি গোপনীয়তা, কুশলতা এবং এমন আতিশয্য দিয়ে প্রকাশ করে, যাতে জনগণের মগজ ধোলাই হয়। ষড়যন্ত্রকারীরা এসব ব্যাপারে আবেগ, দেশপ্রেম ও নেতানেত্রীর ক্যারিশমাকে কাজে লাগায়।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com