লাইলাতুল বরাত

0
877
blank
blank

অধ্যাপক ড. হাফেজ এ বি এম হিজবুল্লাহ: শবেবরাতের শাব্দিক বিশ্লেষণ : ‘শবেবরাত’ দু’টি শব্দের সমষ্টি। প্রথম শব্দটি অর্থাৎ ‘শব’ ফারসি শব্দ, যার অর্থ রাত রজনী। দ্বিতীয় শব্দটি অর্থাৎ ‘বরাত’ আরবি শব্দ, যার অর্থ মুক্তি। এভাবে শবেবরাত অর্থ মুক্তির রাত। বাংলা ভাষায় বরাত শব্দটি ব্যবহৃত ও প্রচলিত যার অর্থ ভাগ্য, অদৃষ্ট। এ ক্ষেত্রে শবেবরাত অর্থ হবে ভাগ্যরজনী।
নামকরণ : হাদিস শরিফে এ রাতটির নির্দিষ্ট কোনো নাম পাওয়া যায় না। বলা হয়েছে শাবান মাসের মধ্য রাত্রি অর্থাৎ শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত। পরে বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থে এর নাম দেখা যায় লাইলাতুল বরাত হিসেবে। শবেবরাত নামটি সম্ভবত পারস্যে ইসলাম প্রচারের পর তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাবে প্রবর্তিত হয়েছে। যেমন সালাত হয়েছে নামাজ আর সাওম হয়েছে রোজা। এভাবেই মোগল আমল থেকে উপমহাদেশে এ নাম প্রসিদ্ধি লাভ করে। লাইলাতুল বরাত বা শবেবরাত অর্থাৎ মুক্তির রাত বা ভাগ্য রজনী হিসেবে কেন নামকরণ করা হয়েছেÑ এর উত্তরে বলা যায় যে, মুক্তির রাত এ জন্য বলা হয়, এ রাতে আল্লাহ পাক তার অসংখ্য বান্দাকে ক্ষমা করে দেন বা জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। আর পরবর্তী বছরের জন্য মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ হয় এ রাতে, তাই এ রাতকে বলা হয় ভাগ্য রজনী। তবে এ রাতকে ভাগ্য রজনী হিসেবে নামকরণ সঠিক নয়। কারণ এ সম্পর্কিত যে তথ্য পাওয়া যায়, তা লাইলাতুল কদর বা শবেকদরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। শবেবরাতের জন্য প্রযোজ্য নয়।
কুরআনে শবেবরাতের কোনো উল্লেখ নেই : কুরআন কারিমে শবেবরাত সম্পর্কিত কোনো আয়াত পাওয়া যায় না। সূরা দুখানের তৃতীয় আয়াতে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ অর্থাৎ বরকতময় রজনী বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে লাইলাতুল কদরকেই বোঝানো হয়েছে। প্রায় সব মুফাসসির এ বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন। ইকরামাসহ অল্প কয়েকজন বলেছেন, এ রাত হলো শাবানের মধ্যরাত্রি বা লাইলাতুল বরাত। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ মুফাসসিরের বক্তব্যই সঠিক। কারণ এ আয়াতে আল্লাহ পাক এক বরকতময় রাতে কুরআন নাজিল করার কথা বলেছেন। সূরাতুল বাকারার এক আয়াতে বলা হয়েছে, কুরআন কারিম অবতরণের সূচনা হয়েছে রমজান মাসে। আবার সূরাতুল কাদরে আল্লাহ পাক লাইলাতুল কদরে কুরআন নাজিলের কথা উল্লেখ করেছেন। আর লাইলাতুল কদর হলো রমজান মাসে, শাবান মাসে নয়। অতএব এখানে লাইলাতুল মুবারাকা অর্থাৎ বরকতময় রজনী দিয়ে লাইলাতুল কদরই নির্ধারিত হবে, শবেবরাত নয়। তাই নিশ্চিতভাবে দেখা যায়, কুরআনে লাইলাতুল বরাতের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।
হাদিসে শবেবরাত প্রসঙ্গ ও এ রাতের ফজিলত : অবশ্য হাদিসে এ রাতের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে বর্ণিত হাদিসগুলো একই মানের নয়। বিতর্কিত ও দুর্বল হাদিসের সংখ্যা বেশি হলেও কিছুসংখ্যক সহিহ হাদিসও রয়েছে, যা এ রাতের অস্তিত্ব প্রমাণে যথেষ্ট।
পাশাপাশি এ রাতের ফজিলতের বর্ণনা ও করণীয় সম্পর্কেও উল্লেখ পাওয়া যায় হাদিসগুলোতে। এখানে কয়েকটি হাদিসের উদ্ধৃতি দেয়া হলো। এক, মুআজ ইবনে জাবাল রা: বলেন, নবী কারিম সা: ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা শাবান মাসের মধ্য রাতে (শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত) সৃষ্টির দিকে (রহমানের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত অন্য সবাইকে ক্ষমা করে দেন। হাদিসটি ইবন হিব্বানসহ অনেকেই বর্ণনা করেছেন। শাইখ নাসিরুদ্দিন আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন এবং এর সমর্থনে তার সিলসিলাতুল আহদিসিস সহিহা গ্রন্থে ৩/১৩৫১৩৯ আরো কিছু হাদিস উল্লেখ করেছেন। দুই. আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাসূলুল্লাহ সা: থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা শাবান মাসের মধ্য রাতে (শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং দুই ধরনের ব্যক্তি ব্যতীত অন্য সব বান্দাকে মাফ করে দেন, বিদ্বেষ পোষণকারী ও হত্যাকারী। ইমাম আহমাদ হাদিসটি তার মুসনাদ গ্রন্থে বর্ণনা করেন। ইবনে হিব্বানও সনদ সহিহ হওয়ার কারণে হাদিসটিকে তার সহিহ গ্রন্থে স্থান দেন। তিন. হজরত আয়শা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, এটি হলো শাবান মাসের মধ্য রাতে (শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত)। আল্লাহ তায়ালা শাবান মাসের মধ্য রাতে তার বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন এবং করুণা প্রার্থীদের করুণা করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থান ছেড়ে দেন। হাদিসটি ইমাম বাইহাকি তার শুআবুল ঈমান গ্রন্থে বর্ণনা করেন এবং হাদিসটির সনদ সম্পর্কে মুরসাল জাইয়েদ অর্থাৎ মুরসাল ভালো বলেছেন। এরপর আশা করি শবেবরাত সম্পর্কে এ কথা বলা যাবে না যে, শবেবরাত সম্পর্কে কোনো সহিহ হাদিস পাওয়া যায় না।
এ রাতে করণীয় আমল : সালাত আদায় করা : ওপরের হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি, আল্লাহ পাক এ রাতে যারা ক্ষমা প্রার্থনা করেন তাদের মাফ করে দেন এবং যারা রহমত চান তাদের রহম করেন। অতএব এ রাতে বেশি বেশি করে আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করতে হবে, চাইতে হবে তার কাছে রহমত। আর মাগফিরাত ও রহমত প্রাপ্তির জন্য প্রচলিত নিয়মে সালাত আদায় করা। এ প্রসঙ্গে হজরত আয়েশা রা: বর্ণিত একটি হাদিস ইমাম বাইহাকি তার শুআবুল ঈমান গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: এ রাতে দীর্ঘ সালাতে রত হন। তিনি এত দীর্ঘ সিজদা করেন যে, হজরত আয়েশা রা: এতে তার ওফাতের আশঙ্কা করেছিলেন। এ বিষয়ে একটি বিষয় অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে যে, শবেবরাতের নামাজ বলে নিদৃষ্ট কোনো সালাত নেই। এ রাতে সালাত আদায়ে নির্ধারিত কোনো নিয়ম নেই বা কত রাকাত সালাত আদায় করতে হবে তারও নিয়ম নেই। প্রথম রাকাতে অমুক সূরা এতবার দ্বিতীয় রাকাতে অমুক সূরা এতবার পড়তে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। অর্থাৎ এক কথায় স্বাভাবিক নিয়মেই সালাত আদায় করতে হবে। তবে সালাতে দীর্ঘ কিরআত হতে পারে, হতে পারে দীর্ঘ সিজদাও।
সাওম পালন করা : প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, শবেবরাতের জন্য কোনো নির্ধারিত সাওম নেই। পনেরো তারিখ আইয়ামে বিজের তিন দিনের (১৩, ১৪, ১৫) একটি দিন প্রতি মাসে রাসূলুল্লাহ সা: এ দিনগুলোতে সাওম পালন করতেন এবং যেহেতু শাবান মাসের এক থেকে ৭০০ পর্যন্ত সাওম পালনের কথা হাদিসে পাওয়া যায় এ দিনগুলোতে সাওম পালন অত্যন্ত বরকতপূর্ণ সেহেতু কেউ যদি এ দুই কারণে ১৫ তারিখের সাওম পালন করেন, তবে তিনি ইনশাআল্লাহ সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবেন না। তবে মনে রাখতে হবে এর সাথে শবেবরাতের কোনো সম্পর্ক নেই এবং এ মাসে নিদৃষ্ট দিনের নিদৃষ্ট কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।
কবর জিয়ারত : ইমাম তিরমিজি হজরত আয়েশা রা: থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, যাতে রাসূলুল্লাহ সা:-এর এ রাতে জান্নাতুল বাকিতে গমনের কথা বলা হয়েছে। অবশ্য ইমাম তিরমিজি উল্লেখ করেছেন, ইমাম বুখারি হাদিসটিকে দুর্বল বলেছেন। এ কারণে অনেক আলেম এ রাতে কবরস্তানে গমন করাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। কেউ কেউ অবশ্য হাদিসটিকে আমলযোগ্য মনে করে কবরস্থানে যাওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি করেননি। তবে অবশ্যই তা প্রতি বছর যেতে হবে এমন নয়। জীবনে একবার গেলেও হাদিসের ওপর আমল হয়ে যাবে। কারণ রাসূলুল্লাহ সা:-এর কবরস্থানে যাওয়া একবারই পাওয়া যায়। তাই নিয়মিত বারবার ঠিক নয়।
অন্যান্য আমল : ওপরের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, লাইলাতুল বরাত বা শবেবরাত একটি মর্যাদপূর্ণ রাত। এ রাতে আল্লাহ পাক বান্দাদের মাফ করেন এবং বান্দাদের ওপর রহমত নাজিল করেন। তাই এ রাতে যেকোনো ধরনের আমল করা যায়। যেমনÑ কুরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ, তাহলিল, ইস্তিগফার প্রভৃতি। তবে অবশ্যই তা হতে হবে শরিয়াতসম্মত। শরিয়াতসম্মত নয় এমন যেকোনো আমল এ রাতে কেন, কোনো সময়ই গ্রহণযোগ্য নয়।
কোথায় কিভাবে আমল করবেন : এসব আমল যেহেতু ফরজ নয় নফল পর্যায়ের, তাই এগুলো নিজ নিজ ঘরে একাকী আদায় করা উত্তম। এতে ঘর হবে বরকতময় আর আল্লাহর রহমতে পরিপূর্ণ। আর যদি মসজিদেও আদায় করেন তা হলে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমল করবেন। অন্যের আমলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবেন না। যেমন জোরে জোরে তিলাওয়াত বা জিকির করবেন না। বয়ানের নামে ভেতর ও বাইরে মাইক ছেড়ে দিয়ে ওয়াজ নসিহত করে অন্যের আমলে বিঘœ সৃষ্টি করা যাবে না। এতে করে মসজিদে যারা একাকী আমল করেন এবং ঘরে পুরুষ-মহিলা যারা নীরবে নিভৃতে আপন পারওয়ারদিগারের ইবাদাতে মশগুল হন তাদের আমলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। তাই এ রাতের আমল সম্পর্কে আগেই অবহিত হতে হবে। ইমাম ও খতিবরা এ সম্পর্কে আগেই মুসল্লিদের জানিয়ে দেবেন।
এ রাতের বর্জনীয় কাজগুলো : এ রাতে অনেকেই এমন কিছু কাজ করেন যা না করলে যেন শবেবরাত পালন হয় না। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হালুয়া রুটির আয়োজন এবং ঘরে ঘরে বিতরণ। এ জন্য এ মাসকে অনেকে মজা করে হালুয়া রুটির মাস বলে থাকেন। আসলে এ ধরনের কোনো কাজ এ রাতে নেই। এ ছাড়া অন্য যেগুলো করা হয়ে থাকে তার মাঝে রয়েছে মসজিদ, ঘরবাড়ি, দোকানপাট ইত্যাদিতে আলোকসজ্জা করা, মোমবাতি জ্বালানো, কবরস্থান ও মাজারে আলোকসজ্জা ও ভিড় করা, পটকা ফুটানো, আতশবাশি প্রভৃতি সবই গর্হিত কাজ। এগুলোর কোনো কোনোটি (যেমন ফকির মিসকিনদের মাঝে খাবার বিতরণ, কবর জিয়ারত) অন্য সময় ভালো অথবা জায়েজ বা সওয়াবের কাজ হলেও শবেবরাতের সাথে এগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। অন্যান্য বিষয়ের সাথে না আছে শবেবরাতের কোনো সম্পর্ক, না আছে শরিয়াতের কোনো সম্পর্ক। বরং এগুলোর কোনো কোনোটি তো শরিয়াতের বিধি অনুযায়ী হারাম ও নাজায়েজ। অতএব এগুলো থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
সবশেষে মনে রাখতে হবে, এ রাতের সব আমলই নফলপর্যায়ের। তাই এগুলোর পেছনে পড়ে যেন ফরজ বাদ না যায়। অর্থাৎ রাত জেগে থেকে ফজরের সালাত যেন কাজা না হয়। কারণ সারা জীবনের নফল একটি ফরজেরও সমান নয়। অতএব যতটুকু সম্ভব আমল করে প্রয়োজনে একটু আরাম করে নিতে হবে যেন কোনো অবস্থাতেই ফজরের ফরজ সালাত কাজা না হয়ে যায়। জামায়াতের সাথে ফজরের সালাত আদায় করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সহিহ আমল করার তওফিক দান করুন।
লেখক : অধ্যাপক, ইবি, কুষ্টিয়া