শুধু ব্যালটবাক্সে ভোট দেয়া গণতন্ত্র না: মার্কিন রাষ্ট্রদূত

0
535
blank
Marsia Barnicut
blank

নিজস্ব প্রতিবেদক: ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে বক্তারা বলেছেন, নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রয়োজন। আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। গণতন্ত্র মানে শুধু ব্যালটবাক্সে ভোট দেয়া না। নির্বাচনের আগে যা হয়, নির্বাচনের সময় ও নির্বাচন পরবর্তী সবকিছুই গণতন্ত্রের অংশ। মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘অ্যাডভান্সিং উইমেনন্স লিডারশিপ ইন ইলেকশন’ শীর্ষক ওই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল।
বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেন, ইসির সংলাপে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলে নারী প্রতিনিধি ছিল না। এমনকি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলেও ছিল না। নারীদের নিয়ে ইসি আলাদা সংলাপ করেছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীদের অবস্থানের প্রশংসা করে সিইসি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে নারীদের অধিকার সমানভাবে প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। সেটার ওপর ভিত্তি করে নারীদের অধিকার নিশ্চিত হবে।
সিইসি বলেন, ১৯৮৬ সালে শেখ হাসিনা পার্লামেন্টে প্রথম নারী বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। নারীরা নিজেদের যোগ্যতা, মেধা, পরিশ্রম, শিক্ষা, চরিত্রের কারণে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে গেছেন। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে নারীদের যে অগ্রগতি পৃথিবীর অন্য কোথাও এরকম নেই। গত ৩১ বছরে প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে নারীরা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। নির্বাচন কমিশনে নারীদের সংশ্লিষ্টতার গুরুত্ব তুলে ধরে কেএম নূরুল হুদা বলেন, নারীরা ভোট জালিয়াতি করেন না। এটা পুরুষদের কাজ। নারীরা যেভাবে ঘর গোছাতে পারেন, তেমনি তারা রাষ্ট্রও গোছাতে পারেন। নির্বাচন কমিশনের আইনি বাধ্যবাধকতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের আইনে সব রাজনৈতিক দলের সকল পর্যায়ে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব রাখার বিধান আছে। কিন্তু নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে এরকম কোনো বিধান নেই। কিন্তু এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই।
গোলটেবিল বৈঠকের বিশেষ অতিথি মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেন, গণতন্ত্র বলতে বিস্তৃত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সকল উপাদানকে বোঝায়। গণতন্ত্র শুধু ব্যালটবাক্সে ভোট দেয়া না। নির্বাচনের আগে যা হয়, নির্বাচনের সময় ও নির্বাচন পরবর্তী সবকিছুই গণতন্ত্রের অংশ। তিনি বলেন, একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে প্রার্থীদের স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণভাবে প্রচারণা চালানোর সুযোগ পাওয়া উচিত। কোনো ধরণের ভয়, ঘর বা চাকুরি হারানোর আশঙ্কা থাকা উচিত না। নাগরিকদের ভোটার হওয়ার স্বাধীনতা থাকতে হবে। বৈধ নির্বাচনের ফলকেও সকলের শ্রদ্ধা করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে দৃঢ় করতে সমাজে নারীদের মুক্ত ও নিরাপদ অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে নারীদের কঠোর পরিশ্রম রয়েছে। স্থানীয়ভাবে ও সরকারের উচ্চপর্যায়ে নেতৃত্বে নারীরা রয়েছেন। কিন্তু নারীরা এখনও রাজনৈতিক দলের এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় পিছিয়ে রয়েছেন।
বার্নিকাট বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থায় নারীদের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ বিভিন্ন কারণে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। ইসলামিক দলগুলোর নেতৃত্বে নারীদের অবস্থান শূন্য। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, ধর্মীয় প্রত্যাশা, লিঙ্গভিত্তিক ও রাজনৈতিক সহিংসতাও নারীদের অংশগ্রহণ না করার কারণ। একটি দৃঢ় গণতান্ত্রিক সমাজে সহিংসতার কোনো স্থান নেই। বাংলাদেশের গণতন্ত্রেও সহিংসতার স্থান নেই। যদি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ ভোট হয় তাহলে ফলাফলের ওপর ভোটারদের আস্থা থাকে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের উদ্দেশ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, আমরা আশা করি শুধু রাজনৈতিক দলের নেতারা নন বরং সকল স্তরের নাগরিকরা একসঙ্গে বসে সমস্যার সমাধান করবেন। আমাদের সুযোগ হয়েছে আজ বাংলাদেশের গণতন্ত্র দৃঢ় করতে আমরা যে অগ্রগতি অর্জন করেছি তা প্রতিফলিত করার এবং আমরা এখনো যে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছি তা নিয়ে কথা বলার।
উপস্থিত নেত্রীদের ধন্যবাদ জানিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একই ধরণের চ্যালেঞ্জের সমাধান করতে এক সঙ্গে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্রে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অগ্রগতির জন্য সংলাপ, সহনশীলতা, বৈচিত্র্য এবং অন্তভূক্তি অর্জনে নারীদের ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম বলেন, বর্তমানে রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীরা অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তৃণমূলে নারীদের কথার কতটুকু গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য দলমত নির্বিশেষে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য নির্বাচন কমিশন কোনো আইন করবে না। নিজ নিজ দলের নেতাদের উপর এজন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে। বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নারী পুরুষকে সমান চোখে না দেখার বিষয়টি বৈশ্বিক সমস্যা বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান। বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে নারীদের প্রতিনিধিত্বের হার তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংরক্ষিত আসনের বিষয়টি নারীদের উন্নয়নের জন্য বাধা হিসেবে কাজ করছে। নারীরা নির্বাচনে জিততে পারেন না এ ধারণা সঠিক না। গঠনতন্ত্র সংশোধন, নির্বাচনে মনোনয়ন প্রক্রিয়া পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তিনি। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে গতিশীল করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতে হবে, একসময় ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। দেশ শাসনের ক্ষমতা জনগণের। তাদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক মানসিকতার পরিবর্তন না করলে কোনো আইন কাজ করবে না। আর এজন্য প্রথম ধাপ হচ্ছে গণতন্ত্র। আমরা আসলে মন থেকে গণতন্ত্র বিশ্বাস করি না, অংশগ্রহণমূলনক রাজনীতি করি না, বৈচিত্র্যতে বিশ্বাস করি না। নারীদের ৩৩ শতাংশ কোটায় বেঁধে না রেখে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর বিষয়ে তাগিদ দেন তিনি। এজন্য সাংঘর্ষিক রাজনীতি থেকে সকলকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি বলতে সবকিছুকে বোঝায়। এটা শুধু নারীদের বিষয় নয়। যেখানে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র থাকবে না সেখানে নারীদের কোনো জায়গা নেই। দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন, মানবাধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বাড়াতে পুরুষদের মানসিকতা পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, আমরা আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখতে চাই। নারী নেত্রীদের যেমন নারীর ক্ষমতায়নের জন্য এগিয়ে আসতে হবে তেমনি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানেও তাদের কাজ করতে হবে।
রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন স্তরের কমিটিতে নারীদের ৩৩ শতাংশ উপস্থিতি এখনই বাধ্যতামূলক করার দাবি জানিয়ে যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল বলেন, নির্বাচন কমিশনের আইনে বিষয়টি পর্যায়ক্রমে করার কথা বলা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে শব্দটি তুলে দিয়ে বাধ্যতামূলক করা হলে নারীদের রাজনৈতিক দলে অংশগ্রহণ বাড়বে।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। নারীদের ভিন্ন কোনো পরিচয়ে নয়, কাজের মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে তাদের ক্ষমতায়ন করতে হবে।
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের চিফ অব পার্টি কেটি ক্রোক বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোতে নেতৃত্ব পর্যায়ে আরো বেশি সংখ্যক নারীর অংশগ্রহণের বিষয়টি আমাকে অনুপ্রেরণা যোগায়। আমি এ বাপারে আত্মবিশ্বাসী যে, সাধারণ নির্বাচনী আসনে নারী নেতাদের মনোনয়ন বৃদ্ধি এবং দলের মূল কমিটিগুলোতে উচ্চ পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
অনুষ্ঠানে সারাদেশ থেকে আসা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র প্রায় ১৫০ জন নারী নেত্রী দলের অভ্যন্তরে এবং আগামী নির্বাচনে নারী নেতৃত্ব বৃদ্ধিতে তাঁদের যৌথ সুপারিশমালাসমূহ দলগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটির নীতি নির্ধারক এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নিকট তুলে ধরেন।
সুপারিশগুলোর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ২০০৯ (সংশোধিত) ধারা ৯০বি বাস্তবায়নে নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনিটরিং সেল গঠন করা যা রাজনৈতিক দলের মূলধারার কমিটিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির হার নিয়মিতভাবে মনিটর করবে। নির্বাচনে সাধারণ আসনে ৩৩% নারী মনোনয়ন দেয়ার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন সংক্রান্ত মনোনয়ন কমিটিতে ৩৩% নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। নির্বাচনে সন্ত্রাস, কালো টাকা এবং পেশীশক্তির অপব্যবহার রোধ করতে নির্বাচন কমিশন থেকে তদারকির ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে এলাকাভিত্তিক পর্যবেক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নারীদের রাজনৈতিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ আসনে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়ার ব্যবস্থা করে উদ্বুদ্ধ করা।