সংস্কার থামাতে সফরে জামায়াত নেতারা

0
1024
blank
blank

সেলিম জাহিদ, ঢাকা:

  • নতুন দল গঠনের লক্ষ্যে গঠিত কমিটি গত দেড় মাসে দুটি বৈঠক করেছে
  • সংস্কারপন্থীদের সামাল দেওয়াতেই বেশি মনোযোগ দিয়েছেন
  • চাপ কাটানোর কৌশল থেকে নতুন সংগঠন গড়ার তাৎক্ষণিক ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল

মুক্তিযুদ্ধের সময় ভূমিকার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়াসহ দলের সংস্কার ঠেকাতে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে সাংগঠনিক সফর কর্মসূচি শুরু করেছেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতারা। তাঁরা এসব সফরে সংস্কারপন্থী নেতাদের অবস্থানের বিরুদ্ধে কথা বলছেন বলে দলের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে।

দলের সংস্কারপন্থীদের চাপের মুখে নতুন নামে দল গঠনের যে ঘোষণা দিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী, সেটারও কোনো অগ্রগতি নেই। দলীয় সূত্র জানায়, নতুন দল গঠনের লক্ষ্যে গঠিত কমিটি গত দেড় মাসে দুটি বৈঠক করেছে। তাতে সম্ভাব্য নতুন দলের গঠন, নেতৃত্ব ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশে কী ধরনের দল হয়েছে, তার তথ্য সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে মিসরের ইখওয়ানুল মুসলেমিন যে ছকে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি গঠন করেছে, সেটার ব্যাপারে জামায়াত নেতাদের অনেকে আগ্রহ দেখান। তবে এই মতামত গ্রহণপ্রক্রিয়াকে অতীতের মতো সময়ক্ষেপণের একটি চেষ্টা বলে মনে করছেন নেতাদের অনেকে।

জামায়াতের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, নীতিনির্ধারকেরা এখন নতুন দল গঠনের চেয়ে সংস্কারপন্থীদের সামাল দেওয়াতেই বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতা সারা দেশে সাংগঠনিক সফর শুরু করেছেন। তাঁরা মাঠপর্যায়ের কর্মী-সমর্থকদের যেকোনো পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ থাকতে এবং সংস্কারপন্থীদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলছেন। কর্মীদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে দলের দুঃসময়ে বিভিন্ন দাবিতে যাঁরা দল ছেড়েছেন, তাঁরা দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। এরই মধ্যে সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান সিলেট মহানগর, নায়েবে আমির গোলাম পরওয়ার খুলনা, রফিকুল ইসলাম খান সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহী, আবদুল্লাহ মো. তাহের কুমিল্লা সফর করেন। এরপর আবদুল্লাহ তাহের গত সপ্তাহে কুমিল্লার একটি আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠান।

জামায়াত সূত্র জানায়, গত ২২ মার্চ শুক্রবার গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে পিকনিকের আবরণে জামায়াতের দায়িত্বশীলদের একটি জমায়েত হয়। দুই শতাধিক লোকের ওই জমায়েতে দলের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ বক্তব্য দেন। ওই বক্তব্যের একটি ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। তাতে দেখা যায়, সংস্কারপন্থীদের দিকে ইঙ্গিত করে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নির্যাতন-নিপীড়নের মুখোমুখি হয়ে আপনারা যাঁরা মনে করেন জামায়াতে ইসলামীর সবকিছু শেষ করে ফেলে দেওয়া উচিত—এটা মিথ্যা, বেইমানি, বিশ্বাসঘাতকতা। যাঁরা ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন সামনে রেখে গবেষণা দিয়ে আমাদের হতাশ করার চেষ্টা করেন, আমি বলব আপনারা হারাম কাজ করছেন।’

সম্প্রতি চাপে পড়ে নতুন দল গড়ার ঘোষণা দেয় জামায়াত। এ লক্ষ্যে শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। কমিটি কাজ শুরু করেছে বলে কেন্দ্র থেকে পাঠানো এক ‘দৃষ্টি আকর্ষণী’ নোটিশে দায়িত্বশীলদের জানানো হয়।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন দল গঠনের ঘোষণার দেড় মাস পার হলেও কমিটির তেমন কোনো তৎপরতা নেই। সম্প্রতি শফিকুর রহমানসহ কয়েকজন নেতা সৌদি আরব যান। তাঁরা সেখানকার দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে একাধিক ঘরোয়া বৈঠক করে দলের ঐক্য অটুট রয়েছে, এমন মনোভাব দেখান।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার ক্ষেত্রে এবং দলের প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে ব্যর্থ হয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেন প্রভাবশালী নেতা আবদুর রাজ্জাক, তিনি দলের জ্যেষ্ঠ সহকারী সেক্রেটারি পদে ছিলেন। এ বিষয়ে প্রকাশ্য অবস্থান নিলে দল থেকে বহিষ্কৃত হন আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা মুজিবুর রহমান (মঞ্জু)। এ পরিস্থিতিতে চাপে পড়ে জামায়াত নতুন সংগঠন গড়ার ঘোষণা দেয়।

আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগের পরদিনই জামায়াত এক ‘দৃষ্টি আকর্ষণী’ নোটিশ পাঠিয়ে মাঠপর্যায়ের দায়িত্বশীলদের জানায়, দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের ১৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত অধিবেশনে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়। শুরা সদস্যদের মতামত পর্যালোচনা করে নির্বাহী পরিষদ সুনির্দিষ্ট কিছু সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নের জন্য সেক্রেটারি জেনারেলের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি কাজ শুরু করেছে।

জামায়াতের সংস্কারমনস্ক নেতারা বলছেন, চাপ কাটানোর কৌশল থেকে নতুন সংগঠন গড়ার তাৎক্ষণিক ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে দলের ভেতরে রক্ষণশীল ও সংস্কারবাদী অংশের নেতা-কর্মীদের মধ্যে চাপা বিরোধ আছে। দুই পক্ষ ভেতরে-ভেতরে তৎপর রয়েছে। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে একদল নেতা সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরার পরপরই সৌদি সফরে যান দলে সংস্কারবাদী নেতা ও সাবেক সাংসদ শাহজাহান চৌধুরী। সৌদি আরবে জামায়াতের সাংগঠনিক অবস্থান ভালো এবং সেখানকার সদস্যদের আর্থিক অবস্থাও ভালো। তাঁদের দেওয়া অর্থ জামায়াতের কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হয়।

এসব বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের জন্য জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও নির্বাহী পরিষদের তিনজন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁরা কেউ আনুষ্ঠানিক মন্তব্য বা নাম প্রকাশ করে কিছু কথা বলতে রাজি হননি। জামায়াতের শীর্ষ পর্যায় থেকে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে নেতাদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।

জামায়াতের রাজনীতির পর্যবেক্ষক হিসেবে পরিচিত সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান বলেন, বিষয়টি আমি সরাসরি জানি না। ভেবেছিলাম তারা খুব তাড়াতাড়ি দল গঠন করবে। আসলে এটা বাস্তবভিত্তিক নয়। কারণ, উপজেলা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত কমিটি করা, দলের জন্য সংবিধান তৈরি করা, এত সহজ কাজ নয়। তাই একটু সময়তো লাগবে।

তবে সংস্কারপন্থী নেতা-কর্মীদের অনেকেই মনে করছেন, নতুন নামে দল গঠনের যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তা কার্যত দলের ভেতরকার চাপ কাটানো এবং উত্তেজনা প্রশমনের একটা কৌশল। কয়েক বছর আগেও চাপের মুখে নতুন নামে দল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন কেন্দ্রীয় নেতা হামিদুর রহমান আজাদকে প্রধান করে একটি কমিটিও হয়েছিল। পরে সে উদ্যোগ থেমে যায়।

[প্রথম আলো]