সুনামগঞ্জে এক সপ্তাহে বজ্রপাতে নিহত ৯

0
463
blank
blank

সুনামগঞ্জ: হাওরের জেলা সুনামগঞ্জে গত এক সপ্তাহে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ ৯ জন নিহত ও ১০ জন আহত হয়েছেন। গত ২৯ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায় বজ্রপাতে মর্মান্তিক এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। হতাহতদের মধ্যে হাওরের ধান কাটার শ্রমিক (নাইয়া), কৃষক পরিবারের সদস্য, স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীও রয়েছে।
গতকাল শনিবার দুপুরে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নে বজ্রপাতে এইচএসসি পরীক্ষার্থীসহ ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন, সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের শাফেলা গ্রামের এখলাছুর রহমান (৫৫) ও একই গ্রামের রাধিকা রানী দাসের মেয়ে একা রানী দাস (১৮)।

সে এবার সদর উপজেলার ইসলামগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। নিহতের স্বজনরা জানান, দুপুরে গ্রামের পার্শ্ববর্তী বোরো ক্ষেতে কাজ করার সময় বজ্রপাতের শিকার হয়ে ঘটনাস্থলেই এখলাছুর রহমানের মৃত্যু হয়। একই সময় বাড়ির উঠোনে কাজ করার সময় একা রানী দাস বজ্রপাতে মারা যায়।

এদিকে গত ২৯ এপ্রিল জেলা সদরে ১ জন, ৩০ এপ্রিল দক্ষিণ সুনামগঞ্জে ১ জন, ১ লা মে সুনামগঞ্জ সদরে ১ জন ও জামালগঞ্জে ২ জন, বিশ্বম্ভরপুরে ১ জন, ৪ মে তাহিরপুরে ১ জন মারা যান। আহত হয়েছেন আরো ১০ জনের অধিক। তাছাড়া কালবৈশাখী ঝড়ে এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক বাড়ি-ঘর ক্ষতিগ্রস্ত ও অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। প্রকৃতির বৈরী আবহাওয়ার কারণে ও বজ্রপাতের আতঙ্কে পাকা ধান কাটার শ্রমিক না পাওয়ায় উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় রয়েছে একফসলী হাওররে কৃষকরা।

ঘন-ঘন বজ্রপাতে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় ধান কাটায় শ্রমিকদের ভয় ও অনাগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে টানা বজ্রপাতে ধান কাটা অবস্থায় হাওরে মারা যাচ্ছেন ধান কাটার শ্রমিকরা। শ্রমিক সংকটের কারণে কৃষক পরিবারের সন্তানরাও অংশগ্রহন করছেন ধান কাটায়। এতে বজ্রপাতের কবলে পড়ছেন তারাও। সুনামগঞ্জে আকষ্মিক বজ্রপাতের আতঙ্কে এখন সংকট আরো তীব্র হচ্ছে। প্রান্তিক কৃষক ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের মতে এখনো হাওরে অর্ধেকের মতো পাকা ধান কাটার বাকি আছে।

বজ্রপাতের আতঙ্কে শ্রমিক সল্পতা সৃষ্টি হওয়ায় ধান কাটা বিলম্বিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, সুনামগঞ্জের হাওরে এ পর্যন্ত ৭৮ ভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে। হাওর বাদে অন্যান্য স্থানে ধান কাটা হয়েছে ৬৫ ভাগ। তবে কৃষক ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন এখন পর্যন্ত হাওরে ৬০ ভাগ পাকা ধান কাটা হয়েছে।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, সকালে হাওরে ধান কাটতে গিয়ে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া দেখে কৃষক ও শ্রমিকরা ঘরে ফিরতে পারেননা। হাওর থেকে গ্রামগুলো অনেক দূরে থাকায় শ্রমিকরা দ্রুত নিরাপদে এসে আশ্রয় নিতে পারেন না, ফলে বজ্রপাতের শিকার হচ্ছেন। গত মঙ্গলবার জামালগঞ্জের পাগনার হাওরে বজ্রপাতে মারা যান কৃষক কমলাকান্ত তালুকদার। আহত হন তার দুই ছেলে ও এক প্রতিবেশি।

গত বুধবার সকালে একই এলাকায় বেলা ১১টায় বজ্রপাতে নিজ জমিতে আহত হন কৃষক সেতু সরকার। গত ১ মে বিশ্বম্ভরপুর, সুনামগঞ্জ সদর এবং জামালগঞ্জে আরো তিন শ্রমিক মারা যান। ধান কাটা অবস্থায়ই হাওরে তাদের মৃত্যু হয়। এসব ঘটনায় কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে শ্রমিকরা বজ্রপাতে প্রাণহানীর ভয়ে ক্ষেতে নামতে চাচ্ছেন না।

দক্ষিণ সুনামগঞ্জের বীরগাঁওয়ের ইমদাদুল হক উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক সাইফুজ্জামান বলেন, বিশাল হাওরে আকষ্মিক ঝড়, বৃষ্টি শুরু হলে দ্রুত গ্রামে এসে পৌঁছতে পারে না কৃষক। ফলে বজ্রপাতের শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন ধান কাটার শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষ। তাই হাওরগুলোতে বিশেষ টাওয়ারের মাধ্যমে বজ্রনিরোধক যন্ত্র স্থাপনের দাবি জানাচ্ছি সরকারের কাছে।

দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামের কৃষক মনির উদ্দিন, মুজিবুর রহমান, হরমুজ আলী, তাহিরপুরের হাওর পাড়ের কৃষক ফেরদৌস আলম, সাদেক আলী, সবুজ মিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলার হাওর পাড়ের কৃষকরা জানান, এবার জেলার প্রতিটি হাওরেই বোরো ধানের ফলন ভাল হয়েছে। তবে আবহাওয়ার বৈরী আচরণে আমরা আবারও চিন্তার মধ্যে আছি। বৃষ্টি হলেই আতঙ্কে সৃষ্টি হয়।

বজ্রপাতের ভয়ে শ্রমিকরা ধান কাটতে হাওরে যেতে চায় না। তাছাড়া ধান কাটার শ্রমিক সংকটের কারণে তারা মুজুরী বেশী দাবী করছে। তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল জানান, প্রকৃতির বৈরী আচরণ হাওর পাড়ে শ্রমিক সংকট বাড়িয়ে দিচ্ছে। তার পরও কৃষকরা নিজেদের মত করে পরিবারের লোকজন নিয়েই পাকা বোরো ধান কেটে শেষ করার চেষ্টা করছে। বজ্রপাত প্রতিরোধে দ্রুত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপরিচালক স্বপন কুমার সাহা জানান, জেলার বেশীর ভাগ পাকা বোরো ধান কেটে ফেলেছে কৃষক। বাকি বোরো ধান দ্রুত কাটার জন্য বলছি আমরা। আশা করি এবার বড় ধরণের কোন ক্ষতি হবে না। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বক্কর সিদ্দিক ভূঁইয়া বলেন, এ সাপ্তাহে প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে। বৃষ্টি হলে পাহাড়ী ঢলে নদীতে পানি বাড়বে। সুরমা নদীতে পানি বাড়ছে পানির উচ্চতা এখন প্রায় ৩ মিটারে দাঁড়িয়েছে। সিলেট আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, ১ মে থেকে ৮ মে পর্যন্ত সুনামগঞ্জের ১১ টি উপজেলায় বৃষ্টিপাত হবে। এরই মধ্যে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে হাওরাঞ্চলে।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাবিরুল ইসলাম বলেন, বজ্রপাতে নিহত কৃষক পরিবারদের সরকারীভাবে অনুদান প্রদান করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধিন রয়েছে।