সুলতান-মোকাব্বিরের শপথ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

0
658
blank

সেলিম আহমেদ: দলীয় সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের বিজয়ী প্রার্থী সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও মোকাব্বির খানের শপথ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে জোটটিতে।

নির্বাচনে নজিরবিহীন কারচুপি ও ভোট ডাকাতির অভিযোগ এনে নির্বাচন বয়কট করা জোটটির কোনো প্রার্থীই শপথ নিবেন না বলে নির্বাচনের পরপরই সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে জোটের পক্ষ থেকে। কিন্তু জোটের এ সিদ্ধান্ত না মেনেই তারা আগামী ৭ মার্চ শপথ নেয়ার ইচ্ছে পোষণ করে স্পিকার বরাবরে চিঠি পাঠিয়েছেন। তাদের চিঠির ভিত্তিতে ওইদিন বেলা ১১টায় তাদের শপথ পড়াবেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।

গণফোরামের বিজয়ী দুই প্রার্থী শপথ নিলে জোটের বা দলের অবস্থান কি হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘গণফোরাম ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে তারা দু’জন শপথ নিলে সেক্ষেত্রে দল থেকে তাদের বহিষ্কার করে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপও নেয়া হবে।’

সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খানের শপথ নেয়াকে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা বলে মন্তব্য করেছেন গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু। তিনি মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘তারা শপথ নেয়ার জন্য যে চিঠি দিয়েছেন দল বা জোটের সঙ্গে আলোচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেননি। এখন আমরা দল ও জোটের বৈঠক করে তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত গণফোরাম ও ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত শপথ না নেয়ার। তারা যদি শপথ নেন তাহলে এটি হবে জনগণের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা।’

ঐক্যফ্রন্টের হয়ে নির্বাচনে বিজয়ী এ দুই প্রার্থীর বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম বলেন, ‘তারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা জনগণ কোনোভাবেই ইতিবাচক হিসেবে নেবে না। বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট, বাম জোট নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। এমনকি সরকারের কোনো কোনো শরিকও এই নির্বাচনের কড়া সমালোচনা করেছে। এই অবস্থায় তারা যদি ব্যক্তিগতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেন তাহলে এটি তাদের জন্য ভালো কিছু হবে না।’

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গণফোরামের সভাপতি প্রবীণ আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, গণফোরাম, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ কয়েকটি সমমনা দল নিয়ে গঠন করা হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। পরে এ জোটে যোগ দেয় কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। জোটটি সর্বশক্তি দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নজিরবিহীনভাবে পরাজিত হয়। ৩০০ আসনের মধ্যে ৮টি আসনে পায় জয়ের দেখা। এই ৮টির মধ্যে ৬টিতে জয় পায় জোটের প্রধান শরিকদল বিএনপি আর অপর দুটিতে জয় পায় গণফোরাম।

গণফোরামের দুই প্রার্থীর মধ্যে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে ধানের শীষ ও মোকাব্বির খান সিলেট-২ আসন থেকে গণফোরামের দলীয় প্রতীক উদীয়মান সূর্য নিয়ে বিজয়ী হন। এদের মধ্যে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ছিলেন একসময় আওয়ামী লীগের ডাকসাইটের নেতা। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, ডাকসুর সাবেক ভিপি আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মনসুর ১৯৯৬ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে মৌলভীবাজার-২ আসনে বিজয়ী হন। পরবর্তীতে ২০০১ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এম শাহীনের কাছে পরাজিত হন। ১/১১ সময় সংস্কারপন্থির কালেমা গায়ে লেপন করে হারান দলীয় পদ-পদবি। আওয়ামী লীগ থেকে কোণঠাসা হয়ে দীর্ঘ দিন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সমালোচনায় লিপ্ত ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিকল্প শক্তি গড়ার লক্ষ্যে চেষ্টাও করেছেন অনেক। নাগরিক ঐক্য, জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সময় ছিলেন অগ্রভাগে। ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যও ছিলেন তিনি।

৩০ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করে মহাজোটের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এম এম শাহীনকে পরাজিত করে চমক সৃষ্টি করেন তিনি। কিন্তু ভোটের পরপরই পাল্টে যান সুলতান। ছিন্ন করেন কামাল হোসেনসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সম্পর্ক। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ঐক্যফ্রন্টের আর কোনো মিটিংয়ে দেখা মেলেনি তার। সিদ্ধান্ত নেন দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নেয়ার।

ঐক্যফ্রণ্টসহ গণফোরামের সিদ্ধান্ত না মেনে শপথ নেয়া প্রসঙ্গে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘আমি গণফোরামের কেউ নই, আমি গণফোরামকে প্রতিনিধিত্বও করি না। আমি জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ছিলাম। কাজেই আমি শপথ নিলে গণফোরামের কে কি বললেন সেটি ভাবার দরকার আমার নেই। আমার এলাকার লোকজন ভোট দিয়ে আমাকে এমপি নির্বাচিত করেছেন, তারা চান আমি যেন সংসদে যাই। ভোটার ও এলাকার জনগণের মতামত অনুযায়ীই আমি সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

গণফোরামে তার অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছি। কিন্তু নির্বাচন করতে হলে নিবন্ধিত দলের সদস্য হতে হয়, তাই আমি গণফোরামের সদস্য হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি। এখন তারা যদি আমাকে দল থেকে বহিষ্কার করে, সেটিকে আমি কেয়ার করি না। তাদের যা সিদ্ধান্ত নেয়ার নিতে পারে।’

অন্যদিকে সিলেট-২ আসনে ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়ন দেয়া হয় নিখোঁজ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা এম. ইলিয়াছ আলী স্ত্রী তাহসিনা রশীদ লুনাকে। সেখানে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দেন গণফোরামের কেন্দ্রীয় নেতা লন্ডন প্রবাসী মোকাব্বির খান। আদালতের নির্দেশে লুনার মনোনয়ন বাতিল হয়ে গেলে ভাগ্য খুলে মোকাব্বির খানের। জোটের সমর্থন পেয়ে বিপুল ভোটে জয়ী হন তিনি। নির্বাচনের পরে শপথ নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্তই তার সিদ্ধান্ত বলে গণমাধ্যমকে জানালেও শেষে পাল্টে নেন সিদ্ধান্ত।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আপত্তি সত্তে¡ও নিজের শপথ নেয়া প্রসঙ্গে মোকাব্বির খান মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘আমি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচন করিনি। আমি গণফোরাম থেকে নির্বাচন করেছি। আমি উদীয়মান সূর্য প্রতীকে নির্বাচিত। তাই আমার শপথ নেয়ার বিষয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কোনো ভ‚মিকা আছে বলে আমি মনে করি না।’ শপথের জন্য ঐতিহাসিক ৭ মার্চ কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মোকাব্বির খান বলেন, ‘দিনটি আমাদের জন্য, দেশের জন্য ঐতিহাসিক দিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির মুক্তির জন্য, ঐক্যর জন্য, স্বাধীনতার জন্য এদিনে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন।

সে কারণে আমার কাছে দিনটি একটি বিশেষ দিন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এজন্যই দিনটি বেছে নিয়েছি’। তিনি বলেন, ‘আমার শপথ নেয়ার বিষয়ে আমার দল গণফোরাম শুরু থেকেই ইতিবাচক। এ বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা হয়েছে। মাত্র দু’-একজন ছাড়া কেউ বিরোধিতা করেনি করছে না।’ দলের সিনিয়র কয়েক নেতার বিরোধিতার পরও শপথ নেয়া হলে দলে কোনো বিভক্তি আসবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মোকাব্বির খান বলেন, ‘আমি মনে করি না। দু’-একজন কেন বিরোধিতা করছেন সেটা তাদেরই জিজ্ঞাসা করুন। আমি তো বিরোধিতার কোনো কারণ দেখি না। তাই এ নিয়ে বিভক্তিরও সম্ভাবনা আছে বলে মনে করি না।’ ড. কামাল হোসেনের কোনো সম্মতি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিনি শুরু থেকেই ইতিবাচক। এখন তিনি বিরোধিতা করছেন কিনা তা তাকেই জিজ্ঞাসা করুন।’

অন্যদিকে গণফোরামের দুই বিজয়ীর শপথ নিয়ে ঐক্যফ্রণ্টের মাঝে দেখা দিয়েছে নেতিবাচক প্রভাব। বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়া জোটটির মধ্যে দিন দিন দূরত্ব আরো বাড়ছে। শপথের সিদ্ধান্তে জোটের বাইরেও সুলতান-মোকাব্বিরের নিজ এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের সময় স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের বিপুল সমর্থন আর সহযোগিতাও পেয়েছিলেন তারা। কিন্তু জোটের বাইরে গিয়ে তাদের এ সিদ্ধান্ত হতাশ করেছে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের দুই নেতা কী করছেন- সেটা বিষয় নয়, ঐক্যফ্রন্ট সম্মিলিতভাবে কী বলছে সেটাই দেখার বিষয়। এখানে দু’জন তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত। এটা নির্ভর করবে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসের ওপর। এখন দেখার বিষয় তিনি কোন সিদ্ধান্ত নেন।’

সূত্র: মানবকণ্ঠ