রুদ্র মুহাম্মদ বশির: আমি যখন দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ি, তখন খাইরুল ইসলাম নামে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়।একই মেসে থাকি। বন্ধের দিন এক সাথে ঘুরতে যাই। সময় পাইলে দুজন গল্প করি।এইভাবে কেটে গেল প্রায় দুই বছর। আমি এইচ এস সি পরীক্ষা দিলাম। দুই বিষয়ে ফেল করায় আমার মনটা ভেঙে গেল। মনে মনে ভাবলাম আর পড়াশুনা করবোনা। এর পরের বছর আর পরীক্ষা দিলাম না। আমার জীবন থেকে একটা বছর চলে গেল। আমি দারুণ মানসিক যন্ত্রণায় ভোগছি।কারও সাথে বলাও লজ্জাবোধ করছি। কি যে করি ভেবে পাচ্ছিনা।
শুক্রবার দিন আমি খাইরুল ভাইকে নিয়ে বাগানে হাঁটতে গেলাম। কথা বলার ফাঁকে এক পর্যায়ে বললাম, ভাই আমি ভাবছি আর পড়াশুনা করবো না। বাড়িতে চলে যাব। উনি বললেন, বাড়িতে গিয়ে কি করবা? কৃষি কাজ করবো। উনি বললেন, না। বাড়িতে যেও না। তোমার তো মেধা আছে। তুমি কেন ফেল করলে? এখন যদি বাড়িতে যাও, তোমার ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাবে। তোমার সহপাঠীরা ভালো কিছু করবে, তুমি তা দেখে কষ্ট পাবে। আর এস এস সি পাশ ছেলেরা পিয়ন ছাড়া অন্য কোনো চাকরি করা সম্ভব না। তাও যদি পাও। যদি বিয়েও কর স্বল্প শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। তোমার ছেলে মেয়েরও ভবিষ্যত অনিশ্চিত হবে। তুমি ভাইয়ের কথা যদি শুন, তাহলে এই বৎসর পরীক্ষা দাও, ইনশাআল্লাহ পাশ করবে। তার কঠিন কথাগুলো তখন আমার কাছে ভালো লাগেনি। আমি উনাকে রেখে একা চলে আসলাম। পরদিন আমি কলেজে গিয়ে একজন শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ করলাম। স্যারও বললেন, তুমি পরীক্ষা দাও, পাশ করবে। দুইজনের কথা শুনে আমি আবার পড়তে রাজি হলাম। দুই বছরের জুনিয়রদের সাথে প্রাইভেট পড়ি। অন্যান্যরা স্যারকে আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলে ও ক্লাস করেনা। স্যারকে আমি আগেই বলেছিলা একথা বলার জন্য।দিনে রাইতে কঠোর পরিশ্রম করে পড়তে লাগলাম। আমার শরীর ক্ষীণ হয়ে আসছে। যে দেখে জিজ্ঞেস করে তোমার শরীর কি খারাপ? তুমি কি অসুস্থ? মানুষের কথায় কান না দিয়ে আমি আমার কাজ চালিয়ে গেলাম। তিন মাস পড়ার পর, পরীক্ষা আসলো। পরীক্ষা দিলাম।ভালো রেজাল্ট করলাম।আমার শিক্ষকরা খুশি হলেন। দোয়া করলেন প্রাণ ভরে।
আমার একজন শিক্ষক বললেন , তোমার শিক্ষা বিরতি যা ছিল, এটা শেষ। তুমি অনার্স পরীক্ষা দেও , ইনশাআল্লাহ ভালো করবে।পরীক্ষা দিলাম, চান্সও পেয়ে গেলাম।ভর্তি হলাম, ক্রমান্বয়ে অনার্স মাস্টার্স পাশ করলাম। অনার্স চলাকালীন বাবও পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, আমি একা হয়ে গেলাম। নিয়তির বিধানে কারও হাত নেই। তারপরও আমি ভেঙে পড়িনি। পড়াশুনা চালিয়ে গেলাম। অনার্স শেষ করার পর, পেশা হিসেবে শিক্ষকতা বেচে নিলাম। এখন পর্যন্ত সেই পেশায় আছি। আজ আমি এই অবস্থানে আসার পিছনে খাইরুল কথাগুলো মন্ত্রের মত কাজ করছে।হয়তো তিনি সেইদিন আমাকে এই কথাগুলো না বলতেন, তাহলে আমার পক্ষে এতদূর পর্যন্ত আসা সম্ভব হতো না। ভালো মানুষের সংস্পর্শে থাকলে অনেক সময় মন্দ লোকও ভালো হয়ে যায়। আমি তার জ্বলন্ত প্রমাণ।আগেকার জ্ঞানীগণ বলতেন ” সঙ্গী গুণে লোহা জলে ভাসে। “এটা চরম সত্য একটি বাক্য।