এমএলএম প্রতারণার শেষ কোথায়?

0
1221
blank
blank

আজমল আহমদ: শত সহস্র হাজার কোটি টাকা গায়েব করা এমএলএম কোম্পানীর প্রতারণা সম্পর্কে কার না জানা। বিগত ১৯ বছরের পর্যালোচনায় অন্তত ১৫০ টি পরিচিত এমএলএম কোম্পানি ও নামসর্বস্ব আরো পনেরশত কোম্পানি মিলে হাজার হাজার কোটি টাকা জনগনের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ কোম্পানি ও কর্তৃপক্ষ উদাও হয়েছে। বিদেশে পাচার হয়ে গেছে দেশে কষ্টে জামানো মানুষের কষ্টার্জিত টাকা। ডেসটিনির-২০০০ লিমিটেড এর লোভনীয় ডাকে গ্রামের গরীব মহিলাদের হাঁস মুরগি বিক্রি করে টাকা দিতে দেখা গেছে। আর ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ইউনিপে টু ইউ, স্পিক এশিয়া, ভিসারেব এর জন্য প্রবাসী স্বামীদের পাঠানো টাকা দিয়েছে দেশে থাকা স্ত্রী। এমনকি বিবাহের শেষ স্মৃতি সোনার গয়নাটি পর্যন্ত বিক্রি করতে করতে পিছপা হননি। কারন একটাই কোম্পানি গুলোর দূরন্ত চালাকি মূলক লোভনীয় প্রচারনা। এতে করে ভেঙ্গে গেছে কত পরিবার, স্বামী স্ত্রীর মাঝে তৈরি হয়েছে সন্দেহ ও মনোমালিন্য। প্রতিটি পবিত্র সম্পর্ক এমএলএম এর প্রতারণার সাথে হারিয়ে গেছে, তলিয়ে গেছে নর্দমায় চিরসুখের প্রেম ও ভালোবাসা।

২০১০-১২ সালে বৃদ্ধ ও মহিলা বাদ দিয়ে এমএলএম কোম্পানি সম্পূর্ন তরুন ও যুব সংগঠকদের নিয়ে তৈরি করল নতুন এক ফাঁদ। উক্ত ফাঁদ প্রতিষ্টিত করতে কোম্পানি পরিচালনায় যুক্ত করা হয়েছিল চিত্র নায়ক রুবেল, আমিন খান ও অমিত হাসানের মত জনপ্রিয় নায়কদের। চরমোনাইর পীরজাদা মাও: ইসহাক নামধারী এক পীর কে চেয়ারম্যান করে ধর্মীয় ভাবাবেগ কাজে লাগিয়ে পুরোপুরি ফাঁদটা প্রতিষ্টিত হয়ে যায়। সেই কোম্পানির নাম ছিল এইমওয়ে কর্পোরেশন। চলচিত্র পরিচালক মাসুদ রানার ব্যবস্থানায় হুমরি খেয়ে পড়েছিল তরুন সমাজ। কিন্তু সর্বশেষ বিশ্বস্থ প্রতিষ্টান এইমওয়ে যখন লাপাত্তা হয়ে যায় তখন সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয় স্বপ্নবান তরুন সমাজ। আর এরপর থেকে শিক্ষিত ও সচেতন সমাজ কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেনা এমএলএম কোম্পানিকে। কিন্তু এর পরেও কিছু এমএলএম লিডার আছে যারা কিছুদিন গাঁ ঢাকা দিয়ে আবারো মাঠে নামে নতুন কোম্পানি নিয়ে। মূলত এরাই প্রতারণার ব্যবসাটাকে জীবিত রেখেছে। ওরা ঠিক পূর্ণ মাদকসেবীর মত যারা গুরে ফিরে ওই মাদকই সেবন করে এ ছাড়া তাদের যেন চলেইনা। একদল হাঁসকে তাড়িয়ে দিলেও আবার ঝুলন্ত ল্যাট্টিনের নিচে চলে যায়। এরাও ঠিক ওই নর্দমার হাঁসগুলির মত। এদিকে নতুন করে ২০১৬-১৭ তে এসে তারা টার্গেট করেছে ১৮ থেকে ২৫ বছরের টগবগে তরুনদের যারা আগে এমএলএম এর প্রতারণার স্বীকার হয়নি। এজন্য দেশের একটি বড় অংশ তরুন সমাজ যারা গড়বে আগামীর সুন্দর পৃথিবী ঠিক তারাই আছে সবচেয়ে বিপদের ফাঁদের মুখে।

দেশে এমএলএম এর ইতিহাস বলছে ১৯৯৮ থেকে প্রকাশ্যে যাত্রা শুরু করে নিউওয়ে নামে প্রথম একটি কোম্পানি। তবে খুব চালাক রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ২০০০ সালে চমক সৃষ্টি করে ডেসটিনি। এর পর তাদের আর পিছু থাকাতে হয়নি। তাদের লোভনীয় প্রচারনা ও গুজবে বিশ্বাসী বাঙ্গালি হুমরি ধুমরি খেয়ে ঝুঁকে পরে উক্ত ফাঁদের পথে। প্রথম ক’বছর কোনরুপ সমালোচনা ছাড়াই একলাফে কয়েক হাজার কোটি টাকা নিজেদের বগলদাবা করে নেয় কোম্পানি গুলো। ৬৫-৭০ লাখ গ্রাহকের টাকা বিদেশ সুবিধাজনক স্থানসমূহে পাচারের পরেই শুরু হয়ে যায় পলায়ন। প্রথমত নিজেদের পেঠ ভরে গেলো, দ্বিতীয়ত মানুষের লভ্যাংশ দেয়ার সময়ও ঘনিয়ে আসছিল। দু’য়ে মিলে পালাতে থাকে কোম্পানি গুলো। শুরু হয় মানুষের টাকা মেরে দেয়ার আর্থিক ধ্বংসের নতুন এক কালো রাত, কালো দিন আর কালো বছর। ২০০৯ এর দিকে সরকারী হিসেবে ৭০ টি কোম্পানি অনুমোদিত বলে জানানো হয় তবে ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত প্রায় পনেরশত অনুমোদন ছাড়া কোম্পানি আত্বপ্রকাশ করে।

কথিত মাল্টিলেভেল ব্যবসার নামে উক্ত ফাঁদে সবমিলিয়ে ক্ষতির স্বীকার প্রায় তিন কোটিরও বেশি মানুষ। ২০১২ থেকে ২০১৪ এর হিসাব অনুযায়ী ৭২ টি কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষনা দেয় দূর্নীতি দমন কমিশন দুদক। অভিযোগ ছিল সাধারণ মানুষের ৯০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া। সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন গনমাধ্যমে আসা তথ্যের ভিত্তিতে তালিকা করে দুদক। এরমধ্যে ৫টি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলাও করে দুদক। কিন্তু অজ্ঞাত কারনে দুদকের কার্যক্রমের শিতিলতা লক্ষ্য করা যায়। আর সেই সুযোগেই এমএলএর দৌড়াত্ব বাড়ছে বৈ কমছেনা। সম্প্রতি সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা দুদকের কাছে ১৫৬ টি কোম্পানির বিরুদ্ধে মুদ্রা পাচারের অভিযোগ পাঠিয়েছে। দুদক বলছে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শীগ্রই আরো জোড়ালো ভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ৫৮ জন চিহ্নিত এমএলএম প্রতারকের ছবি ও বায়োডাটা ঝুলছে সীমান্ত ইমিগ্রেশন পুলিশের চেকপোষ্টে ও দেশের সকল বিমানবন্দরে, যাতে তারা পালিয়ে না যায়। কিন্তু পুলিশ ধারণা করছে এই তালিকা তৈরির আগেই কমপক্ষে ৩০-৪০ জন দেশ থেকে পালিয়ে গেছে।
সর্বশেষ সিলেট প্রসঙ্গে বলতে গেলে দেখা যায়, বিগত ১৮ বছর থেকেই সময়ে সময়ে ছোবল দিচ্ছে এলএমএল নামক কালসাপ। নিউওয়ে, ডেসটিনি, এইমওয়ে, ইউনিপে টু ইউ, ভিসারেব, স্পীক এশিয়া, ভিশন প্লাস, অথেনটিক ইত্যাদি কোম্পানি গুলো সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেছে সিলেটবাসীর। ক্ষতির মধ্যে আছে হাজার কোটি নগদ টাকা, সম্পদ বিক্রি, অসম্মান, অপয়ার অপবাদ, মারামারি, বন্ধুত্বের মাঝে ফাটল, আত্বীয়ের সাথে মনোমালিন্য ইত্যাদি। আর এর ধারা যে শেষ হয়ে গেছে তাও নয়। নতুন নতুন কোম্পানি আসছে, পূরণ করছে তাদের দূরবিন্ধীমূলক মনোবাসনা, আর ক্ষতি করে যাচ্ছে সিলেটবাসীর। এতোকিছুর পরেও সিলেটে লুকিয়ে চলছে ডেসটিনির কিছু কার্যক্রম, ফরেএভার, মডার্ণ হারবাল, এনেক্স, তিয়ানসি ইত্যাদি সহ আরো কিছু অনলাইন ভিত্তিক কোম্পানি। একদম শেষদিকে নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে জার্মান ভিত্তিক কোম্পানি ইলগামস। যার দেশে কোন সরকারী অনুমোদন নাই, এমনকি বিদেশ ভিত্তিক এরকম শূন্যের উপর ভাসমান কোম্পানির দেশে কোন অনুমোদন বা লাইস্যান্স এর সুযোগও নেই। সরকার লাইস্যান্স না দেয়ার পক্ষে তার কঠোর অবস্থান পরিষ্কার করেছে। যে এমএলএম-এ সামাজিক কোন সম্মানের পরিচয় নেই, গর্ব করার মত কোন পেশাও নয় এটি, এমনকি সরকারী কোন বৈধতাও নেই এর পরেও কিভাবে কোম্পানরি সাথে মানুষ শরীক হচ্ছে? অন্তত শিক্ষিত সমাজের বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। কারন এমএলএম এখন আর ভালো কোন নাম নয়, অন্তত তিনকোটি ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের দেয়া নতুন নাম “হায়হায় কোম্পানি”।

লেখক: তরুন কবি ও কলাম লেখক।