অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিতে এজেন্ট ব্যাংকিং

0
52
blank
blank

আফরিন সুলতানা
বিশ্বের উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকে প্রাধান্য দানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উপযোগিতা বৃদ্ধি এবং উন্নয়নে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত রেখেছে। অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বলতে মূলত শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে একটি দেশের সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন আর্থিক সেবার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করাকে বোঝায়। ফলে আর্থিক লেনদেনে গতিশীলতা পায়, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। এতে অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা ও উন্নয়ন বৃদ্ধি পায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে ২০১০ সালের শেষার্ধে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির যুগে আনুষ্ঠানিকভাবে পদার্পণ করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পরিচিতির মাধ্যমে। মোবাইল ডিভাইস ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দ্রুত জনপ্রিয়তায় প্রধান বিশ্লেষক ভূমিকা পালন করে থাকে। উল্লেখ্য যে বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন সাবস্ক্রাইবার ১৮.৯১৩ কোটি, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০৪ শতাংশ (একই ব্যক্তি একাধিক মোবাইল ফোন সাবস্ক্রাইবার থাকায়) এবং এর প্রায় ৫৮ শতাংশ মোবাইল ইন্টারনেটের সচল ব্যবহারকারী (সূত্র: এএমটিওবি, ২০২৩)।

বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার রেজিস্টার্ড অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ২১.৫০ কোটি (সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক, সেপ্টেম্বর-২০২৩), যা দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের তুমুল জনপ্রিয়তা ও সুবিধামূলক ব্যবহারযোগ্যতার প্রমাণস্বরূপ। তবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন দ্রুত ও সুবিধাজনক হলেও আর্থিক সেবার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন সঞ্চয় ও ঋণ গ্রহণের ব্যবস্থা না থাকায় অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির মৌলিক উদ্দেশ্য পূরণ ব্যাহত হয়। তাছাড়া লেনদেন-প্রতি খরচ ও নির্দিষ্ট সীমা থাকায় ব্যবসায়িক লেনদেনে বড় অংকের পরিশোধ গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে। যার প্রতিফলন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (মাসিক) প্রতিবেদনেও ফুটে উঠেছে। ওই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সচল ব্যবহারকারীদের সংখ্যা আগস্টের তুলনায় ৯ দশমিক ৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মোট লেনদেনের সংখ্যা ও পরিমাণ যথাক্রমে ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ ও ১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জনে ও আর্থিক সেবা প্রদানে নতুন এবং বিকল্প হিসেবে বর্তমানে ‘এজেন্ট ব্যাংকিং’ বেশ আলোচ্য একটি মডেল। প্রথম ব্রাজিল এ পরিচিতি ও সফলতার পর বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে মডেলটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে একটি ব্যাংক বড় পরিসরে শাখা না খুলেও ছোট আউটলেট ও উপশাখা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে পারে। ছোট পরিসরে ও কম জনবল নিয়ে সেবা প্রদান করার ফলে তুলনামূলক কম খরচে আর্থিক সেবাগুলো পরিচালনা করা, একই সঙ্গে প্রান্তিক অঞ্চলগুলোয় ঋণ প্রদান, সঞ্চয় গ্রহণ ও বৈদেশিক রেমিট্যান্স আদায় সহজলভ্য হওয়ার ফলে ব্যাংক এবং গ্রাহকদের কাছে মডেলটি অত্যধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে।

২০১৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংক এশিয়া প্রথম এজেন্ট ব্যাংকিং সূচনা করে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৩১টি ব্যাংক দেশব্যাপী ২১ হাজার ২৮৮টি আউটলেটের মাধ্যমে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা প্রদান করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রিপোর্ট (জুন-২০২৩) অনুযায়ী এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার আওতাভুক্ত গ্রাহকদের মোট অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ১৯,৮৫২,২৪০টি, যা গত বছরের জুনের অ্যাকাউন্ট সংখ্যার তুলনায় প্রায় ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সঞ্চয় জমা, মূলধন গঠন, বিনিয়োগ ইত্যাদি অর্থনৈতিক কার্যকলাপ প্রসারিত হচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান ঋণ গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। উল্লেখ্য, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর মোট সংগৃহীত ডিপোজিটের ১৯ দশমিক ৫ শতাংশই এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত হয়েছে। ব্যাংকগুলোর প্রদানকৃত মোট ঋণের শূন্য দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ এজেন্ট আউটলেটের মাধ্যমে বণ্টিত হয়েছে। রেমিট্যান্স আদায়ের বৈধ মাধ্যম হিসেবে এজেন্ট ব্যাংকিং দেশের বৈদেশিক মুদ্রা তহবিল সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া এজেন্ট আউটলেটগুলোয় পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে মডেলটি দেশের বেকারত্ব হ্রাসেও ব্যাপক অবদান রাখছে। সুতরাং অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির অগ্রগতিতে বাংলাদেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা রয়েছে।

(আফরিন সুলতানা: সহকারী অধ্যাপক, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)

সৌজন্যে: বণিক বার্তা