সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক:
আজকের কলামের প্রেক্ষাপট
বিগত ঈদুল ফিতরের আগে একটি বুধবার এবং ঈদুল ফিতরের পরে দু’টি বুধবার কলাম লিখতে পারিনি; পাঠকরা বঞ্চিত হয়েছেন, এর জন্য দুঃখিত। ১২ জুলাই তারিখে প্রকাশিত কলামের শিরোনাম ছিল : ‘সংবিধান নতুন করে ছাপাতে হবে। কেন?’ এরপর ১৯ জুলাই প্রকাশিত কলামের শিরোনাম ছিল ‘নির্বাচন, নিরাপত্তা ও সেনাবাহিনী প্রসঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা-১।’ ১২ জুলাই তারিখের কলামে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা কিছুটা আলোচনা করেছি। ভবিষ্যতে হয়তো আবার করব। নির্বাচনকালীন যেকোনো সরকারের সাফল্য নির্ভর করবে, একটি সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠান করানোর ওপর। নির্বাচনের সংজ্ঞা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিকশনারিতে বা পাঠ্যবইয়ে যত বিস্তারিত ও স্পষ্টভাবে দেয়া আছে, অনুরূপ ব্যাখ্যামূলক আলোচনা আছে সুন্দর নির্বাচন প্রসঙ্গে, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রসঙ্গে। ইংরেজি পরিভাষায় শব্দগুলো হলো ক্রেডিবল ইলেকশন, অ্যাকসেপ্টেবল ইলেকশন। কোনো একটি নির্বাচন যদি সুন্দর হতে হয়, ক্রেডিবল হতে হয়, গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য হতে হয়, তাহলে সেখানে অনেক উপাত্ত কাজ করবে। আমার বিবেচনায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত হলো নিরাপত্তা; এরূপ নিরাপত্তা তথা নির্বাচনকালীন নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে ১৯ জুলাই তারিখের কলামটিতে লিখেছি। আজকের আলোচনা এর ধারাবাহিকতায়।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের বিখ্যাত নির্বাচনে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট র্যাংকধারী অফিসার ছিলাম এবং তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমার শেরপুর থানায় নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেছিলাম, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানির একটি অংশ নিয়ে। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পার্লামেন্ট নির্বাচনে ক্যাপ্টেন র্যাংকধারী অফিসার হিসেবে তৎকালীন ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমায় দায়িত্ব পালন করেছিলাম, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পুরো ‘সি’ কোম্পানি নিয়ে। এর পর থেকে (১৯৮৬ সাল ব্যতীত) ১৯৯৬ সালের জুন পর্যন্ত সব নির্বাচনে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম বা ভূমিকা রেখেছি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিশেষ ভূমিকা ছিল, সরকারি দায়িত্বের অংশ হিসেবে (সে প্রসঙ্গে আগামী সপ্তাহে আবার লিখব)। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচন চলাকালে যশোর অঞ্চলের জিওসি ছিলাম; অতঃপর নির্বাচনের আট দিন আগে যশোর থেকে বদলি হয়ে ঢাকায় চলে আসি; কিন্তু জিওসি হিসেবে নির্বাচনকালীন সৈন্য মোতায়েন পরিকল্পনা ও দায়িত্ব বণ্টন করে এসেছিলাম। আমি চলে আসার পরেও পরবর্তী জিওসি মহোদয়, ওই পরিকল্পনার কোনো ব্যত্যয় ঘটাননি। ১৯৯৬ সালের জুন মাসের ১৫ তারিখ বাধ্যতামূলক অবসরে যাই; ১৯৯৭ সালের ১৫ জুন আমার এলপিআর শেষ হয় এবং আমি সেনাবাহিনীর জনবল থেকে চূড়ান্তভাবে বিয়োগ হয়ে যাই। আমার অবসর জীবনে, ২০০১ সালের নির্বাচনকালে নিজেদের একটি এনজিও (নাম ছিল সোহাক) নিয়ে, এশিয়া ফাউন্ডেশনের সার্বিক সহযোগিতায়, ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে, কয়েকটি উপজেলায় ইলেকশন মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পালন করেছি। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরের ৪ তারিখ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং ১৭ নভেম্বর ২০০৮ তারিখে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পাই। আমাদের নিবন্ধন নম্বর ০৩১ এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত আমাদের দলীয় মার্কা হলো ‘হাতঘড়ি’। আমাদের দলীয় পরিচয়ে এবং দলীয় মার্কা নিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিজে প্রার্থী ছিলাম এবং কল্যাণ পার্টির পক্ষ থেকে ৩৬টি আসনে প্রার্থী ছিল। এই প্রেক্ষাপট বর্ণনার উদ্দেশ্য হলো, সম্মানিত পাঠকের সামনে এটা তুলে ধরা যে, নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা নিয়ে আমরা অতীতেও চিন্তা করেছি এবং বর্তমানেও করছি। তার থেকেও বড় কথা, ওইরূপ চিন্তা করার জন্য আমরা যথেষ্ট অভিজ্ঞতা পেয়েছি। কারণ, নির্বাচন নামক প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত ছিলাম। কলাম লিখেছি এবং আজকেও লিখছি। নিশ্চিতভাবেই অতীতের দুই সপ্তাহের কলাম, আজকের কলাম এবং আগামী দুই সপ্তাহের কলাম, একই সুতায় গাঁথা। সুতার নাম : নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা; নির্বাচনকালে মানুষের মনে আস্থা। এই কলামের পরবর্তী অংশটুকু, গত সপ্তাহের কলামের বর্ধিত অংশ।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের চিন্তা
নির্বাচনকালে নিরাপত্তার সাথে সেনাবাহিনীর ভূমিকা জড়িত। ২০০০ সালের প্রথমাংশে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার, একটি ধারণা বা কথা, রাজনৈতিক বাজারে ছেড়ে দেয়। তা ছিল : নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী মোতায়েনের কোনো প্রয়োজন নেই। তৎকালীন নাগরিকসমাজের সচেতন অংশ সরকারের ওই ধারণা বা মনোভাবকে সিরিয়াসলি গ্রহণ করেছিল। আমি তখনো একজন রাজনৈতিক কর্মী হইনি। সচেতন নাগরিকসমাজের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলাম। অতএব, এই বিষয়টি আমার বা আমার সাথে ঘনিষ্ঠ যারা, তাদের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। তখন যেমন মনে করতাম, এখনো মনে করি যে, বাংলাদেশের পার্লামেন্ট নির্বাচনকালে, জনমনে শান্তি, স্বস্তি ও আস্থা তথা সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানের জন্য সামরিক বাহিনীর তথা সেনাবাহিনীর ভূমিকা অপরিহার্য। ২০০০ সালের বাংলাদেশ সরকার যেমন আওয়ামীলীগ দলীয় ছিল, ২০১৩-১৪ সালের এবং ২০১৭ সালের সরকারও আওয়ামী লীগদলীয়। ২০০০ সালে বা ২০০১ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগদলীয় সরকার এবং আওয়ামী লীগ যে ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি, তারা সেই ধারণাটিকে ২০১৩-১৪ সালে প্রায় প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে তারা নির্বাচন থেকে অনেক দূরে রাখবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কম্বোডিয়া বা লাইবেরিয়া বা বসনিয়া কিংবা কঙ্গো নামক দেশগুলোয় নির্বাচনে ওতপ্রোত সহায়তা করুক, এতে আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দলের বা আওয়ামী লীগদলীয় রাজনৈতিক সরকারের কোনো আপত্তি নেই; কিন্তু বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করানোর কাজে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোনো ভূমিকা রাখুক, এতে তাদের যথেষ্ট আপত্তি। বিষয়টি বিদঘুটে এবং আলোচনার দাবি রাখে। সেই আলোচনা গত সপ্তাহের কলামের মাধ্যমে শুরু করেছি। আগ্রহী পাঠকেরা নিশ্চিতভাবেই কলামটিকে নিজের সংগ্রহে রাখবেন। আজকের কলামটিকেও সংরক্ষণে রাখবেন এবং বন্ধু-বান্ধবকে রাখায় সাহায্য করবেন।
প্রচলিত নিরাপত্তার রেওয়াজ
আমাদের দেশের নির্বাচনকালীন যে নিরাপত্তা ব্যবস্থার রীতি, তা খুবই গতানুগতিক। গত ৪০-৪৫ বছরেও এই ব্যবস্থায় বা রেওয়াজে বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি। বহু বিষয়ে পরিবর্তন সূচিত হলেও নির্বাচনকালীন নিরাপত্তায় শৈথিল্য রীতিমতো আশ্চর্যের বিষয়। সুতরাং এই গতানুগতিক নিরাপত্তাব্যবস্থার পরিবর্তন অপরিহার্য। সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি দল (যেমন বিশ-পঁচিশজনের একটি দল) পরোক্ষভাবে একটি থানা এলাকায় নিরাপত্তা প্রদান করা, অথবা সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি দল (দশ-বারোজন) কোনো একটি থানার সদর দফতরে আসন গেড়ে বসে ওই থানার সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি কষ্টসাধ্য ও প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। র্যাবও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দেয়। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন; এরাও কোনো কোনো জায়গায় নিরাপত্তা দেয়। তবে নির্বাচনের আগে সাধারণত নিরাপত্তার দায়িত্বটি পুলিশের হাতে থাকে; চাইলে বা মোতায়েন করা হলে সেনাবাহিনী সেখানে ভূমিকা রাখে। নির্বাচনের আগের রাত, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচনী দিনের পরবর্তী রাত এ এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকে পুলিশ এবং আনসার বাহিনীর ওপরে। এই দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে নির্বাচনী কেন্দ্র বা ভোটকেন্দ্র বা পোলিং সেন্টার অনুযায়ী পুলিশ-আনসার মোতায়েন করা হয়। সীমান্তবর্তী থানার ব্যাপারে পরে বলছি। সামগ্রিকভাবে নির্বাচনের দিনে, ভোটকেন্দ্রের বাইরে যে নিরাপত্তা প্রয়োজন, যার আলোচনা গত সপ্তাহে করেছি, সে সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা খুবই কম।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার্য দিন
বর্তমানে বাংলাদেশে পার্লামেন্টারি নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হয়। এক দিনে করার পরিবর্তে, একাধিক দিনে করা যায় কি না, বা একাধিক দিনে করা উচিত; কিন্তু সেটিও সময়োপযোগী আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশে পার্লামেন্টারি নির্বাচনে পোলিং স্টেশনের সংখ্যা ছাব্বিশ হাজারের বেশি। প্রত্যেক কেন্দ্রে একজন বা দ্ইুজন অস্ত্রধারী পুলিশ, একজন বা দুইজন অস্ত্রধারী আনসার এবং অনধিক বারোজন অস্ত্রধারী নয়, এমন আনসার থাকে। আনসাররা আসে নির্বাচনের দু’-তিন দিন আগে। তাদের অ্যামবডিমেন্ট করা হয় এবং নির্বাচনের এক দিন বা দুই দিন পরই তাদের ডিএমবিডমেন্ট করা হয়। সেনাবাহিনী প্রসঙ্গে ২০১৪ সালের অভিজ্ঞতা বাদ দিচ্ছি : কেন বাদ দিচ্ছি সেটা এই কলামের একদম শুরুতেই আছে। ১৯৭৩ সালের মার্চের নির্বাচন থেকে ২০০৮-এর ডিসেম্বরের নির্বাচন পর্যন্ত, সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে যে রেওয়াজ ছিল সেটি এখানে আলোচনা করছি। দেশব্যাপী সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় পাঁচ থেকে ৯ দিনের জন্য। এই ছবিটি দেশের শতকরা ৯০ ভাগ নির্বাচনী কেন্দ্রের জন্য প্রযোজ্য। বাকি আনুমানিক ১০ ভাগ নির্বাচনী কেন্দ্রকে আমরা বলতে পারি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’। সেখানে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে কয়েকজন বেশি পুলিশ বা আনসার মোতায়েন করে। নির্বাচনী কেন্দ্রে সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ডিউটি করে না। মহানগরীগুলোয় বিডিআর নির্বাচনী কেন্দ্রে প্রত্যক্ষ ডিউটি করলেও অন্যত্র প্রত্যক্ষ ডিউটি করে না। দেশের প্রতিটি থানায় আলাদাভাবে সেনাবাহিনী বা বিজিবি (সাবেক বিডিআর) মোতায়েন করা হয়।
থানার সংখ্যা ও নিরাপত্তাবাহিনী মোতায়েন
বাংলাদেশের ১২০টি থানা বা উপজেলা আছে যেগুলো সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত তথা তাদের সাথেই আন্তর্জাতিক সীমান্ত। এ ছাড়াও সমুদ্রবেষ্টিত বা দ্বীপাঞ্চলীয় থানা আছে পাঁচ-ছয়টি; যেগুলোয় নির্বাচনকালে নৌবাহিনী পাঠানো হয়। বর্ডারিং থানাগুলোয় সাধারণত সেনাবাহিনী পাঠানো হয় না, বরং বিজিবি (সাবেক বিডিআর) পাঠানো হয়। বিজিবি ‘পাঠানো’ বললে ভুল হবে, বিজিবি সীমান্ত এলাকায় সারা বছরই ডিউটি করছে। সুতরাং বিজিবি পাঠানো মানে ঢাকা বা সংশ্লিষ্ট সেক্টর থেকে অতিরিক্ত কিছু বিজিবি পাঠানো যাতে করে বিওপিগুলো একদম সৈন্যবিহীন না হয় বা বর্ডার প্যাট্রোলিং একদম বন্ধ হয়ে না যায়। বর্ডারিং থানাগুলোয় সেনাবাহিনী পাঠানো হয় না ইচ্ছাকৃতভাবে, যাতে সীমান্ত এলাকায় সেনাবাহিনীকে চলাচল করতে না হয়। দেশের অন্য সব থানায় সেনাবাহিনী পাঠানো হয়। কোনো জায়গায় ৩০ জন, কোনো জায়গায় ৪০ জন ও কোনো জায়গায় ৫০ জন এভাবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল প্রভৃতি নগর বা মহানগরে সেনাবাহিনী বা বিজিবি উভয়ই মোতায়েন করা হয়। বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও ভিডিপিÑ এসব বাহিনী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পড়ে। দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা তথা স্বাভাবিক সব কর্মকাণ্ডের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব পড়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর। বেসামরিক প্রশাসন তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করার জন্য দেশের বিদ্যমান আইনের অধীনেই সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
সেনা মোতায়েন দর্শন বা তত্ত্ব
পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত, প্রচলিত বা অনুসরণ করা যে থিওরি বা তত্ত্বের ভিত্তিতে সেনাবাহিনী নির্বাচনকালে দায়িত্ব পালন করে আসছে সেটি হলো, ‘বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় কর্তব্য পালন’ তথা ইংরেজি পরিভাষায় ‘ডিউটিজ ইন এইড অব সিভিল পাওয়ার’। মূল লক্ষ্য হচ্ছে: শো অব ফোর্স বা শক্তি প্রদর্শনের দ্বারা অশান্তি সৃষ্টিকারী মানুষের মনে, বিশেষত সন্ত্রাসীদের মনে ‘ডিটারেন্স’ বা গণ্ডগোল না করার মানসিকতা সৃষ্টি করা; সেই সাথে, শান্তিপ্রিয় জনগণের মনে আস্থার সৃষ্টি করা। সেনাদল কোনো থানা বা উপজেলায় মোতায়েন হওয়ার পর বেশির ভাগ সময় যানবাহনে করে এবং কম সময় হেঁটে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়। এটিই তাদের প্রধান কাজ। যদি নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের দিন কোনো ম্যাজিস্ট্রেট আনুষ্ঠানিকভাবে বলেন যে, কোনো এক জায়গায় গণ্ডগোল হচ্ছে যা দমন করার জন্য সেনাবাহিনী প্রয়োজন, তাহলেই কেবল ওই সেনাদল কাজে লাগে, তা না হলে শো অব ফোর্সেই তাদের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ থাকে। বাংলাদেশের অনেক থানায় বা উপজেলায়, ২০১৭ সালে এসেও যোগাযোগের ব্যবস্থা এমন যে, ওইগুলোর অভ্যন্তরে চলাচলের উন্নত ব্যবস্থা নেই। অতিরিক্ত কোনো যানবাহনও নেই; ওইসব দুর্গম জায়গায় চান্দের গাড়ি বা ভ্যান বা গরুর গাড়ি বা নসিমন-ভটভটি বা ট্রাক্টর ছাড়া অন্য কোনো বাহন নেই। আরো কিছু থানা আছে যেগুলো এতটাই নদীমাতৃক যে, সেখানে কোনো সড়কই নেই। ফলে চলাচলের উপযুক্ত বাহন হচ্ছেÑ স্পিড বোট, শ্যালো ইঞ্জিনচালিত দেশী নৌকা, লঞ্চ ইত্যাদি। যানবাহনের অপ্রতুলতা ও যানবাহন চলাচলের সড়কের অভাবের কারণে এবং সৈন্যসংখ্যার স্বল্পতার কারণে একটি থানায় মোতায়েন করা সেনাদল বা বিজিবি দলের পক্ষে সব সময়ই একটি স্থানেই উপস্থিত থাকা সম্ভব হয়, কোনো কোনো সময় দু’টি স্থানে উপস্থিত থাকা সম্ভব হয় এবং কদাচিৎ তিনটি বা তার অধিক স্থানে উপস্থিত থাকা সম্ভব হয়। কতজন সৈনিক একটি থানায় বা উপজেলায় সাধারণত মোতায়েন করা হয়? এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় যে, ২৫ থেকে ৮০ জন পর্যন্ত হতে পারে। আরো একটি উল্লেখযোগ্য বক্তব্য হচ্ছে, বিদ্যমান আইনে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যতীত সেনাদল কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। অতএব, ম্যাজিস্ট্রেটের অপ্রতুলতা সেনাবাহিনীর কার্যক্ষমতা বিকাশে একটি সীমাবদ্ধতা।
শো অব ফোর্স’ তত্ত্ব এবং বর্তমান মানসিকতা
ওপরে বর্ণিত ‘শো অব ফোর্স’ বা ডিটারেন্স তত্ত্বটি এখন কতটা বাস্তবসম্মত, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। আমার মূল্যায়নে, সেনাবাহিনীকে শুধু দেখেই ভয় পাওয়ার দিন চলে গেছে। কোনো উপজেলায় বা থানায় সেনাদল সশরীরে কোন জায়গায় অবস্থান করছে, ওই সেনাদলের কাছে কী যানবাহন আছে, থানা বা উপজেলার অভ্যন্তরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে ওই সেনাদলের বা তাদের একটি অংশের কত সময় লাগবে ইত্যাদি কোনো গোপন ব্যাপার নয়। এসব তথ্য বা মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে একটি সেনাদল কোনো একটি থানায় মোতায়েনরত অবস্থায় কী কী কাজ করতে পারবে বা কী কী করতে পারবে না, সেটি সচেতন জনগণ বিশেষত রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা অতি সহজেই হিসাব করে ফেলতে পারে। সম্মানিত পাঠক, লক্ষ করুন যে শব্দযুগল ব্যবহার করেছি সেটি হলো রাজনৈতিক সন্ত্রাসী। এ জন্যই বললাম যে, ‘শো অব ফোর্স’ তত্ত্বের কার্যকারিতা এখন অতি সীমিত। বিশেষত, এক দিন-দুই দিন একটি এলাকায় ঘুরে এলেই, রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা ওই এলাকা ছেড়ে পালাবে, এমন নাও হতে পারে। তাহলে কী করণীয়? সেনাবাহিনীকে এমন একটি সময় হাতে রেখে মোতায়েন করতে হবে, যেন সেনাবাহিনীর দল যাদেরকে সেকশন বা প্লাটুন বা কোম্পানি বলা হয়, এরূপ দলগুলো যেন তাদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা নিবিড়ভাবে চেনে এবং ওই এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে নিবিড় জ্ঞান অর্জন করে। সে জন্যই ‘বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় সেনা মোতায়েন’-এর বিধি তথা ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ আংশিকভাবে বদল করার সময় এসেছে। এই প্রসঙ্গে আলোচনা আগামী সপ্তাহে অব্যাহত থাকবে।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com