গণগ্রেপ্তার বন্ধ করার আহ্বান হিউম্যান রাইটস ওয়াচের

0
1099
blank
blank

ডেস্ক রিপোর্ট:  সেকুলার লেখক, সমকামী অধিকার কর্মী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা তদন্ত করা এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনা উচিৎ বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের। কিন্তু, অপরাধের যথাযথ প্রমাণ ছাড়া বাছবিচারহীনভাবে মানুষকে গ্রেপ্তার করা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিৎ। সম্প্রতি, কয়েক দিনে বাংলাদেশে কয়েক হাজার মানুষকে গ্রেপ্তারের প্রেক্ষিতে এ কথা বলেছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

সংস্থাটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ১০ই জুন থেকে ১৬ই জুন পর্যন্ত, সেকুলার বা নাস্তিক্যমনা ব্লগার, অমুসলিম, এলজিবিটি সম্প্রদায়ের সদস্য ও অন্য প্রগতিশীল বা উদারপন্থী বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো ১১ হাজারেরও বেশি মানুষকে আটক করেছে। যারা আটক হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ কর্মকান্ডের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকা সাপেক্ষে অভিযোগ গঠন করে অবিলম্বে আদালতের সামনে উপস্থিত করা উচিৎ। অন্যথায়, তাদের অবিলম্বে মুক্তি দেয়া উচিৎ।

সংস্থাটির এশিয়া পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, ‘এসব ভয়ঙ্কর হামলায় মন্থর ও প্রসন্ন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো। এখন তারা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সুষ্ঠু তদন্ত করার বদলে, ‘গড়পড়তা সন্দেহভাজন’দের ধরপাকড় করার পুরোনো অভ্যাসে ফিরে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই হত্যাকা-গুলো বন্ধে ও দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করতে সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সরকারকে এসব করতে হবে নিজেদের ফৌজধারি দ-বিধি ও আন্তর্জাতিক আইনে বেঁধে দেয়া যথাযথ নিয়মের মধ্য দিয়ে।’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ লিখেছে, ওই হত্যাকা-ের প্রতিক্রিয়ায় কর্তৃপক্ষ প্রথম দিকে ছিল মন্থর। কয়েকটি মামলায় অল্প ক’ জনকে আটক করা হয়। এ ধরণের কয়েকটি মামলায়, এইচআরডব্লিউ দেখতে পেয়েছে যে, ওই আটককৃতদের আনুষ্ঠানিকভাবে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করার কয়েক সপ্তাহ আগেই পুলিশ তাদের আটক করেছিল। তখন তাদের অবস্থান স¤পর্কে পরিবারকে কিছুই জানানো হয়নি। এদেরকে আইনি সহায়তা লাভের সুযোগ দিতেও ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ।
তবে, ২৫শে এপ্রিল দুই সমকামী অধিকার কর্মীর আলোচিত হত্যাকা- এবং ৫ই জুন সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এক জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকে হত্যার পর, এসব হত্যাকা- অবসানে চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দেয় সরকার। এরপরই গণগ্রেপ্তার শুরু হয়।
প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এইচআরডব্লিউ লিখেছে, ইসলামী মূল্যবোধ ধারণ করে না, কথিত এমন ব্লগার ও অন্যদের হত্যা শুরু হয় ২০১৩ সালের দিকে। ২০১৪ সালে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে স্থগিত ছিল এই হত্যাযজ্ঞ। ২০১৫ সালে আবারও শুরু হয়, যা এখনও চলছে। এই ‘চাপাতি হামলা’ প্রথমদিকে শুধু ব্লগারদের ওপরই হতো, যারা প্রকাশ্যে ধর্মনিরপেক্ষ বা নাস্তিক্যবাদী মূল্যবোধ নিয়ে লেখালেখি করতেন। কিন্তু পরে ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, অধ্যাপক, শিক্ষার্থী, প্রকাশক ও সর্বশেষ এলজিবিটি অধিকার কর্মীদের টার্গেট করা শুরু হয়।
সরকারের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় হত্যাকা-ের নিন্দা জানানো হতো বটে। কিন্তু, যারা টার্গেট হয়েছেন, তাদের প্রতি আহ্বান জানানো হতো এসব কর্মকা- বন্ধ করতে কিংবা লেখালেখি সেন্সর করতে। ২০১৩ সালে, কর্তৃপক্ষ চার ব্লগারকে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ দেয়ার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করে। ২০১৫ সালে, ব্লগার নিলাদ্রি চ্যাটার্জি নিলয়ের হত্যাকা-ের পর, বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক মত প্রকাশের অধিকার সুরক্ষিত করার বদলে ব্লগারদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া একটি অপরাধ’।
সাম্প্রতিক ধরপাকড়ের অকল্পনীয় বিবরণ ইঙ্গিত দেয় যে, এসব অতীতের ধরপাকড়ের মতোই। পুলিশ নির্দিষ্ট কিছু জিনিসের সঙ্গে মিলে গেলেই লোকদের থামাচ্ছে। বিশেষ করে, যেসব এলাকায় পুলিশের সন্দেহ জঙ্গিদের আনাগোনা রয়েছে, সেখানে তরুণদের সঙ্গে এমনটা করা হয়। পুলিশের নিজেদের সূত্রই বলছে যে, আটককৃত ১১ হাজারেরও বেশি মানুষের মধ্যে মাত্র ১৪৫ জন কোন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। এসব অপরাধের সঙ্গে কোন ব্যাক্তিবিশেষকে জড়িত করতে কোন সংগঠনের সদস্য হওয়াটাই যথেষ্ট প্রমাণ নয়।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, আটককৃতদের অনেককেই তাদের মুক্তির বিনিময়ে ঘুষ দিতে বাধ্য করা হয়েছে। এটি বাংলাদেশে সাধারণ চিত্র। উদাহরণস্বরূপ, এইচআরডব্লিউর কাছে জানানো হয়েছে চলমান ধরপাকড়ের একটি ঘটনা। তাতে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ একজন তরুণকে আটক করেছে। তাকে নিজেদের হেফাজতে (কাস্টোডি) নিয়ে মারধোর করে। এরপর তার কাছ থেকে এক লাখ টাকা ঘুষ দাবি করে। অন্যথায়, তাকে সন্দেহভাজন মৌলবাদীদের তালিকায় ঢুকিয়ে দেয়ার হুমকি দেয় পুলিশ।
বাংলাদেশে নির্যাতন ও হেফাজতকালীন (কাস্টোডিয়াল) নির্যাতনের বেশ ভালো নথিবদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। তাই আটক বা জিজ্ঞাসাবাদকালীন অবস্থায় আটককৃত ব্যাক্তির ক্ষতি হওয়ার সত্যিকার ঝুঁকি রয়েছে। এইচআরডব্লিউ নিজেই বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটককৃতদের নির্যাতন ও কাস্টোডিয়াল নির্যাতনের বিষয়টি নথিবদ্ধ করেছে। ২০০৮ সালে সংস্থাটির নিজেদেরই একজন পরামর্শকের (তাসনিম খলিল) ঘটনাও নথিভুক্ত ঘটনাসমূহের মধ্যে রয়েছে।
২০১২ সালে এইচআরডব্লিউ’র একটি প্রতিবেদনে নথিবদ্ধ করা হয়েছে বাংলাদেশ রাইফেলস কর্তৃক ২০০৯ সালের বিদ্রোহের ঘটনায় জড়িত সন্দেহভাজনদের গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হেফাজতকালীন মৃত্যুর ঘটনাসমূহ। এইচআরডব্লিউর পরবর্তী তদন্তসমূহে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারির সহিংস নির্বাচনের আগে ও পরে বাছবিচারহীনভাবে অবৈধ গ্রেপ্তার হয়েছে। কয়েকটি ঘটনায় অনেকের মৃত্যু ও গুমের ঘটনা ঘটেছে।
এইচআরডব্লিউ উল্লেখ করেছে যে, নির্যাতন ও বিচারহীনতার প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ প্রদর্শনের প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দিয়েছিল।

ব্রাড অ্যাডামস বলেন, ‘মাত্র কয়েকদিনের মাথায় হাজার হাজার মানুষের গণগ্রেপ্তার বাংলাদেশে একটি পরিচিত দৃশ্য। কিন্তু, এর মাধ্যমে ওই ভয়াবহ হত্যাকা- থামবে বা সুষ্ঠু প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে, তার ভরসা খুবই কম।’ তিনি বলেন, ‘দুনিয়াকে সংক্ষুদ্ধ করে দেয়া ধারাবাহিক হত্যাকা-গুলোর পরিকল্পনা ও সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করতে আন্তরিক তদন্ত পরিচালনা করা প্রয়োজন কর্তৃপক্ষের।’