ছাত্রলীগে ‘১৯’ আতঙ্ক

0
604
blank
blank

মাহমুদুল হাসান নয়ন: ছাত্রলীগে এখন বড় আতঙ্কের নাম গাণিতিক সংখ্যা ‘১৯’। সংগঠনটির ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে তুমুল বিতর্কের ফলে কেন্দ্রীয় নেতাদের জন্য সংখ্যাটি এখন ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কেন্দ্রীয় কমিটির অর্ধশত বিতর্কিত নেতাকে বাদ দিতে পদবঞ্চিতদের আন্দোলনের মুখে ১৯টি পদ শূন্য ঘোষণা থেকেই এ আতঙ্কের উৎপত্তি। ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ শূন্যের এ সংখ্যা ঘোষণা করলেও পদ বা ব্যক্তির নাম ঘোষণা করেনি। ফলে এই ১৯ জন কারা- সেটাই এখন সংগঠনটির আলোচনার কেন্দ্রে। এ অবস্থায় পদ পেয়েও প্রত্যাশিত উচ্ছ্বাস নেই কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে।

অন্যদিকে বিতর্কিতদের বাদ দিতে রোজার মধ্যে টানা ছয় দিন রাজু ভাস্কর্যে পদবঞ্চিতদের অবস্থান, এ আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। যদিও ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে তার নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে শূন্যপদ বাড়তে পারে, কমতেও পারে।

গত ২৮ মে দিবাগত রাত ১টায় এই ১৯টি পদ শূন্য ঘোষণা করেন ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এর আগে গত ১৩ মে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হয়। ৩০১ সদস্যের এ কমিটির শতাধিক নেতার বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে পদ পাওয়া এবং বিভিন্ন অন্যায়, অপকর্ম ও অনুপ্রবেশের অভিযোগ ওঠে। নতুন কমিটির সদস্যদের মধ্যে হত্যা মামলার আসামি থেকে শুরু করে বিবাহিত, বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্টতা, মাদক গ্রহণ ও ব্যবসা, চাকরিজীবীর নাম রয়েছে। অন্যদিকে এই কমিটিতে জায়গা হয়নি সর্বশেষ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ ও অবস্থানে থাকা প্রায় অর্ধশত নেতার। এতে ক্ষোভ জানিয়ে কমিটি প্রত্যাখ্যান করলে তাদের ওপর দু’দফায় হামলা করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা।

১৫ মে চাপের মুখে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ১৭ জন বিতর্কিত নেতার একটি তালিকা প্রকাশ করেন। তাদের বিরুদ্ধে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তথ্য-প্রমাণসাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করে পদগুলো শূন্য হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর ১৬ মে বিভিন্ন অপরাধ অপকর্মে জড়িত এবং সংগঠনের গঠনতন্ত্র ও রেওয়াজ পরিপন্থী উপায়ে পদপ্রাপ্ত বিতর্কিত ৯৯ নেতার নাম প্রকাশ করেন পদবঞ্চিতরা। সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্ব ও পদবঞ্চিতদের এমন মুখোমুখি অবস্থানের ফলে আওয়ামী লীগের ৪ সিনিয়র নেতার হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ১৭টি পদ শূন্য ঘোষণা করেনি।

এদিকে কমিটি গঠনের পর ১৫ মে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে সংগঠনটির নতুন কমিটির শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছিল। তখন অপরাধী ও বিতর্কিতদের কমিটি থেকে বাদ দিতেও নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। অথচ সেই নির্দেশনা পালন না করে ২৭ মে মধ্যরাতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন কর্মসূচি ঘোষণা করে ছাত্রলীগ। ফলে ২৬ মে দিবাগত রাত ১টা থেকে ফের আন্দোলনে নামেন পদবঞ্চিতরা। শুক্রবার টানা ষষ্ঠ দিনের মধ্যে অবস্থান অব্যাহত রেখেছেন তারা। আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে যোগ্যদের পদায়ন না করা পর্যন্ত তারা এ অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। ১৯টি শূন্য পদের নাম প্রকাশের দাবিও রয়েছে তাদের। দাবি না মানলে তারা বাড়ি যাবেন না, ঢাকায়ই ঈদ করবেন।

ছাত্রলীগের সদ্যবিদায়ী কমিটির প্রচার সম্পাদক (বর্তমান কমিটিতে পদবঞ্চিত) সাইফ উদ্দিন বাবু যুগান্তরকে বলেন, আন্দোলনের মুখে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক প্রথমে ১৭ জনের কথা স্বীকার করলেও ১৪ দিন পর ১৯ জনের পদ শূন্য করার কথা উল্লেখ করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। তাদের এই পদক্ষেপ আজ প্রমাণ করল আমাদের দাবি ও আন্দোলন গুরুত্বহীন ছিল না। ১৯টি পদ শূন্য হলেও এখন পর্যন্ত যে যার মতো স্বপদে বহাল আছে। এটা শুধু সুপরিকল্পিত নয়, অপরাজনীতি ও চাতুরীও বটে। অবিলম্বে শূন্য হওয়া ১৯ জনের নাম ও পদের বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে। একই সঙ্গে তাদের সব দাবি মেনে কমিটি পুনর্গঠন না করা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।

সদ্যবিদায়ী কমিটির কর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক রাকিব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, অভিযুক্ত শতাধিক নেতার নাম আমরা বলেছি। তাদের মধ্যে অকাট্য দলিলসহ ৫০ জনের তালিকা দিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে অসংখ্যবার যোগাযোগ করেও পাইনি। পরে নানক ভাইকে (জাহাঙ্গীর কবির নানক) দিয়েছি। অথচ নতুন নাটক সাজিয়ে ১৯টি পদ শূন্য ঘোষণা করে একটি প্রেস রিলিজ দেয়া হয়েছে। যা একেবারেই অস্পষ্ট। সেখানে কারও নাম নেই, কোনো কিছু সুস্পষ্টভাবে বলা হয়নি। আমরা এই ছল-চাতুরীর প্রতিবাদ জানাই। ১৯টি শূন্যপদের নাম ঘোষণা করতে আমরা ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিলাম। তা-ও মানা হয়নি। এভাবে সংগঠন চলতে পারে না। আমাদের দাবি, সব বিতর্কিতকে সংগঠন থেকে বাদ দিতে হবে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তা না করা পর্যন্ত লাগাতার আন্দোলন চলবে।

এ ছাড়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির অন্তত ১০ জন নেতা যুগান্তরকে বলেছেন, এই ১৯টি শূন্যপদের নাম ঘোষণা করা উচিত। কারণ তারা পদ পেয়েও এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। তৃণমূলে সেভাবে কাজ করতে পারছেন না। অনেকেই জিজ্ঞেস করছেন, ‘ভাই, উনিশ জনের মধ্যে আছেন নাকি?।’ তারা বলছেন, সামনে ঈদ। পদপ্রাপ্তদের প্রায় সবাই গ্রামের বাড়িতে যাবেন। নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। অথচ পদ নিয়ে ধোঁয়াশা অবস্থার কারণে তারা কর্মসূচি সাজাতে পারছেন না। তাই ঈদের আগেই শূন্যপদের বিষয়টি স্পষ্ট করার দাবি জানিয়েছেন তারা।

শূন্যপদের নাম ঘোষণা না করার বিষয়ে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী যুগান্তরকে বলেন, যেসব পদ শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে তাদেরকে কিন্তু সংগঠন থেকে অব্যাহতিও দেয়া হয়নি বহিষ্কারও করা হয়নি। যেহেতু অভিযোগ এসেছে তাই ১৯টি পদ শুধু শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এই ১৯ জনের বিষয়ে আমরা কিছু জায়গায় সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। যেমন, এদের একজন বিয়ে করেছে কিন্তু বউ মারা গেছে। আরেকটা মেয়ের ডিভোর্স হয়েছে তিন বছর আগে। আরেকজন তিন বছর আগে চাকরি করত। আমরা এদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না বলে আমাদের একমাত্র অভিভাবক জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য অপেক্ষা করছি। তিনি দেশে ফিরলে তার সঙ্গে কথা বলে শূন্যপদের নাম ঘোষণা করা হবে।

ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, আমাদের যে বিতর্কিতদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে অনীহা নেই, সেটা বোঝানোর জন্যই পদগুলো শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে। আপা (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) দেশে এলে তার কাছে অভিযুক্তদের নাম, পদ ও অভিযোগ উত্থাপন করা হবে। পরে তার নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করব। এ ক্ষেত্রে শূন্যপদ বাড়তেও পারে, কমতেও পারে। গঠনতন্ত্রের বয়সের নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্রলীগের প্রথম গঠনতন্ত্র শেখ হাসিনা। আমরা যদি তাকে বোঝাতে পারি যে দলের বৃহত্তর স্বার্থে একটা ছেলে তার বয়স যদি দুই মাস বেশি হয়, আপা যদি তাকে রাখতে বলেন, তাহলে সে থাকবে। তবে সিদ্ধান্ত অবশ্যই আপার।

আন্দোলনকারীদের কাছে বিতর্কিত অর্ধশত নেতার অকাট্য দলিল আছে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গোলাম রাব্বানী বলেন, অকাট্য দলিল একজনেরও নেই। এটা যদি তারা বলে থাকে ভুল বলেছে। অকাট্য দলিল থাকলে তো আমদেরই দিত। ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বা দফতর সেলে অভিযোগ না দিয়ে মিডিয়াকে বা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের দেয়ার সুযোগ নেই।

[যুগান্তর]