ঢাকা: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৫ তারিখে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ কর্তৃক জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এসডিজি নামে পরিচিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ’ সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করা হয়। এর মাধ্যমে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ১৫ বছরের একটি বৈশ্বিক করণীয় তালিকা তৈরি করেছেন এবং পৃথিবীব্যাপী মানুষের জীবন-মান উন্নয়নে সকল ক্ষেত্রে একগুচ্ছ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার কাঠামো তৈরি করে দিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সরকার এবং সেবমূলক প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ ও সমাজকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রণীত চরম দারিদ্র্যদূরীকরণ, লিঙ্গ সমতা অর্জন, জলবায়ু ঝুঁকি অবসান ও সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করার মতো এই বৈশ্বিক লক্ষ্যগুলো বিশ্বব্যাপী মনোযোগ, শক্তি ও সম্পদের সমন্বয়কে সুসংহত করবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো মানবজাতির বিভিন্ন গুরুতর সমস্যার সমাধানে উচ্চাকাঙ্ক্ষী পদক্ষেপের মাধ্যমে পৃথিবীকে বদলে দিতে যাচ্ছে।
এই লক্ষ্যগুলোর একটি- লক্ষ্য নম্বর ৮- সবার জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েছে। আমি এই লক্ষ্যটিতে একটি নতুন প্রেক্ষাপট যোগ করতে চাই। এই লক্ষ্যটি কর্মসংস্থান সম্পর্কে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা মাথায় রেখে প্রণয়ন করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিটি এই ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব মানুষকে চাকরি করেই জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। আমি মনে করি যে, এই দৃষ্টিভঙ্গিটির সম্পূর্ণ পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। আমি বিশ্বাস করি যে, সব মানুষই জন্ম নেয় উদ্যোক্তা হওয়ার ডিএনএ ধারণ করে। মানব সভ্যতার উষালগ্নে আমরা মানুষকে দাসত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছি। শিল্প বিপ্লবের শুরুতে আমরা তাদের চাকরি প্রার্থীতে পরিণত করলাম। এমনকি পৃথিবীতে এত পরিবর্তন সত্ত্বেও আমরা এখনও এই পুরোনো ধারণা আঁকড়ে আছি যে, কোনো নিয়োগকারী তাদের কাজে না লাগিয়ে দেয়া পর্যন্ত তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই- সব মানুষের জন্ম হয়েছে কিছু মানুষের অধীনে থেকে তাদের শ্রম ও মেধা বিক্রির জন্য। মানুষ সম্পর্কে পুরোপুরি ভুল একটি ধারণার ওপর ভিত্তি করেই আমরা আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করে বসে আছি। আর এর ফলে বেকারত্বের সমস্যাটি সৃষ্টি করেছি।
আমরা ভুলে যাই যে, এই গ্রহে মানুষের জন্ম হওয়ার পর থেকে তাকে নিজের উদ্যোগে প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সমস্যা-সমাধানকারী হিসেবেই সে টিকে গিয়েছে, টিকে গিয়েছে তার সীমাহীন সৃষ্টিশীল সক্ষমতার কারণে। প্রতিটি মানুষের ভেতরেই সকল প্রতিকূলতা জয়ী উদ্যোক্তা হওয়ার মূল গুণটি কখনও লুপ্ত হয়নি, শুধু ভুল চিন্তার কারণে অব্যবহৃত রয়ে গেছে। প্রতিটি শিশুকে- ছেলে হোক, মেয়ে হোক- তাকে উদ্যোক্তা হয়ে বেড়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে, চাকরি খুঁজবে এই চিন্তা যেন তার মনে প্রশ্রয় না পায়। একেবারে শৈশব থেকেই তার উদ্যোক্তা গুণটির ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। সমস্যা সমাধানের দিকে তৎপর করে তুলতে হবে। বাস্তব সমস্যা সমাধানে তার ক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলতে হবে, উৎসাহ দিতে হবে, তার ক্ষমতাকে বন্ধনমুক্ত করে দিতে হবে। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, আমরা প্রতি বছর বিশ্ব চাকরি বাজারে ৬০ মিলিয়ন নতুন চাকরি প্রার্থী নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, যেখানে প্রতি বছর ৬০ মিলিয়ন নতুন উদ্যোক্তা পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে তাদের সৃষ্টিশীল শক্তি নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্ত হচ্ছে- এটাই বরং খুশির খবর হিসেবে পত্রিকায় হেডলাইন হওয়ার কথা ছিল।
প্রায় ৪০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক তার ৮৬ লাখ ঋণগ্রহীতাকে, যাদের ৯৭% দরিদ্র নিরক্ষর মহিলা, বিনা জামানতে ঋণ দিয়ে থাকে। তারা বাংলাদেশে তাদের নিজ নিজ গ্রামে তাদের ব্যবসায়িক উদ্যোগ শুরু করতে এই ঋণ ব্যবহার করে। যদি দরিদ্র নিরক্ষর মহিলারা সমাজের যাবতীয় ঘৃণ্য নির্যাতনের ভেতরেও নিজেদের উদ্যোক্তায় পরিণত করতে পারে, তাহলে সারা পৃথিবীতে লাখ লাখ স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় পাস ছেলেমেয়েরা প্রযুক্তির প্রচণ্ড শক্তিতে বলীয়ান হয়ে কী করতে পারার কথা- একবার কল্পনা করে দেখুন তো! এর জন্য যা দরকার তা হলো শুধু চিন্তার পরিবর্তন, শিক্ষার পরিবর্তন আর ব্যাংকিং ব্যবস্থার পরিবর্তন। এ কাজটা করার জন্য আমি একটি পদক্ষেপ নিয়েছি। আমি গ্রামীণের ঋণীদের সন্তানদের মূলধন ও ঋণ অর্থায়ন জোগান দিতে সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠন করেছি। এর মাধ্যমে অর্থ জোগান দিয়ে বেকার ছেলে ও মেয়েদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য উৎসাহিত করছি। এই তহবিল টাকা বিনিয়োগ করে তাদের ব্যবসার অংশীদার হচ্ছে, তাদের ব্যবসা থেকে কোনো লাভের প্রত্যাশা না করে। ব্যবসার সকল মুনাফা নবীন উদ্যোক্তাদের কাছেই থাকছে। তারা লাভের টাকা থেকে গৃহীত মূলধনের টাকা ফেরত দিয়ে অর্থায়নকারীর শেয়ারগুলো কিনে নিয়ে ব্যবসার পূর্ণ মালিক হয়ে যাচ্ছে।
এই অভিজ্ঞতা থেকে আমার একটি বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে যে, বেকারত্ব একটি কৃত্রিম সমস্যা। আমি কোনো কারণ ৩৫ পৃষ্ঠায় দেখুন
দেখি না কেন তরুণরা বেকার বসে থাকবে যেখানে পৃথিবীতে করার মতো এত কিছু তাদের হাতের ছোঁয়া পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
তরুণ্যকে তার সত্যিকারের মৌলিক সত্তাটি আবিষ্কারের সুযোগ করে দিয়ে পৃথিবীব্যাপী নবীন উদ্যোক্তাদের একটি জোয়ার সৃষ্টির কাজে আমাদের এখনই ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার। আমাদের একটি শক্তিশালী উদ্যোক্তা-উন্মোচন উদ্যোগ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে পৃথিবীর সর্বত্র তরুণরা এমনকি গহীন এলাকার এবং সাংস্কৃতিকভাবে, শিক্ষার দিক দিয়ে ও নৃতাত্ত্বিকভাবে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরাও পৃথিবীর অন্য যেকারো সমান আর্থিক সুযোগ পাবে। এই নতুন পরিবেশ সৃষ্টি করা গেলে তরুণরা শিগগিরই বুঝতে পারবে যে তাদের জন্ম হয়েছে চাকরি সৃষ্টি করতে, চাকরি খুঁজতে নয়। এখনকার মতো চাকরীর সন্ধানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গোপনে অপরিচিত দেশে পাড়ি জমাবার কোনো প্রয়োজন তাদের হবে না। যদি যায় তারা উদ্যোক্তার পরিচিতি নিয়ে যাবে, যে দেশে যাচ্ছে সে দেশ তাকে অভ্যর্থনা করে গ্রহণ করবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভিন্নভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেখানে নবীন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। তরুণরা পাঠ শেষ করে হাতে চাকরির আবেদনপত্র নিয়ে নয় বরং ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নিয়ে বের হবে। তারা সমাজের মাথাব্যথার কারণ হবে না বরং অর্থনীতিতে নতুন শক্তি যোগাবে।
নবীন উদ্যোক্তাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার যে প্রস্তাব আমি করছি, বেকারদের জন্য রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত অনুদান প্রদানের যে কর্মসূচিগুলো প্রচলিত আছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এর গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য আছে। আমরা যদি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের ৮নং লক্ষ্যটিকে এই নতুন অভিমুখীনতায় নির্মাণ করতে পারি, তাহলে আমরা নতুন প্রজন্মকে একটি নতুন প্রেক্ষাপটে দেখতে পাবো। এর অর্থ হবে বিশ্ব সমাজ তরুণদেরকে উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে প্রস্তুত হয়েছে এবং তাদের মানবসমাজের অগ্রগতিতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে দেখতে চায়। সরকার, শিক্ষাবিদ, সিভিল সোসাইটি, বেসরকারি খাত, ক্রমবর্ধমান সামাজিক ব্যবসা খাত এবং পৃথিবীর সকল নাগরিকের সমর্থন ও সহায়তা নিয়ে নবীন উদ্যোক্তারা একটি নতুন সমাজ সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিতে পারে। তারা এমন পৃথিবী সৃষ্টি করতে পারে যেখানে ‘বেকারত্ব’ বলে কোনো শব্দের প্রয়োজন হবে না। ‘বেকারত্ব’ শব্দটিই বেকার হয়ে যাবে।