রাধারমণ দত্তের ১০১তম মৃত্যু বার্ষিকী বৃহস্পতিবার

0
1446
blank
blank

মো. মুন্না মিয়া, জগন্নাথপুর: বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিন পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত জগন্নাথপুর উপজেলা। এ উপজেলা অধিবাসিরা প্রাচীন কাল থেকেই অন্যান্য এলাকার তুলনায় সম্পদে যেমন সুখি, তেমনি ভাবে সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও সুখি। এবং এই উপজেলায় অধিবাসিরাই দেশ-বিদেশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা প্রাচীনকাল থেকে রেখে আসছেন।
বিস্তৃত জগন্নাথপুর উপজেলার হাওড়-বাওড়, বিল-ঝিল,নদী-নালা প্রভৃতিতে পরিপূর্ন। প্রাক্রতিক মনোমূর্গ্ধকর পরিবেশে সুপ্রাচীন কাল থেকেই এখানে অনেক আউল-বাউল,পীর-ফকির,বৈষব-ভাবুক,সাধক ও রাজনৈতিকের জন্ম হয়। জন্মের পর থেকেই তাঁরা তাঁদের মহান কৃতিত্ব দ্বারা দেশ-বিদেশে জগন্নাথপুর উপজেলা তথা সারা বাংলাকে সুনামের সাথে তুলে ধরেছেন। যাদের কৃতিত্বে জগন্নাথপুর উপজেলা গুনানীত তাঁরা হলেন সাধক সৈয়দ শাহ হোছন আলম,মরমি কবি সৈয়দ আসহার আলী চৌধুরী,সৈয়দ শাহপুর,রাধারমন দত্ত,আছিম শাহ এবং কালু শাহ। তাঁর এখানকার মাটিকে বিশ্বের দরবারে উজ্জল করে রেখে দিয়েছেন। তাঁদের অমর রচিত বাণীতে বাংলার লোকসংগীত আজ পরিপূর্নভাবে গড়ে উঠেছে। তাঁদের নিজস্ব সৃষ্টিতে মরমী সংগীতের অমৃত রসের ধারা বইয়ে দিয়েছেন এবং আজও বধি তাঁদের কৃতকর্ম মানুষের মনে মনি কোঠায় সুর ঝঙ্কারের সৃষ্টি হয়েছে। এই জগন্নাথপুরে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হয়ে চির নিদ্রায় সাহিত হয়ে আছেন রাধারমন দত্ত। তিনি ছিলেন একজন মহান সাধক। তিনি বাংলায় ধামাইল সংগীতের সৃষ্টি করেছেন। লোকসংগীতের পুরোধা। লোককবি হিসেবে সমগ্র বাংলায় তিনি পরিচিত। তিনি মহৎ প্রাণ ব্যাক্তিত্বের আবির্ভাবে মানব সমাজের প্রভূত কল্যানে নিজেকে সাধিত করেছেন।
রাধারমন দত্ত ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ১২৪১ বাংলায় সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার আতুয়জান পরগনার কেশবপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি বাল্যকাল থেকেই ধর্মীয় ভাবপন্ন ছিলেন। এবং শাস্ত্রীয় পুস্তকাদির চর্চা ও সাধু সন্ন্যাসীদের সংস্পর্শ খুবই ভাল বাসতেন। সাধক রাধারমন দত্তের পিতা রাধামাদব দত্ত এবং মা সূর্বণা দেবী।
বৈষব কবি রাধারমন দত্ত পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় উপসনার প্রধান অবলম্বন সংগীতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল শৈশব থেকেই। খ্যাতিমান লোককবি জয়দেবের গীতাগৌবিন্দের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন রাধারমন দত্তের পিতা রাধামাধব দত্ত। তিনি পিতার সংগীত ও সাধনায় সাংস্কৃতি অঙ্গনে আরোও প্রভাবিত হয়ে উঠেন। ১২৫০ বঙ্গাব্দে রাধারমন পিতাহারা হয়ে মা সূর্বণা দেবীর কাছে বড় হতে থাকেন। ১২৭৫ বঙ্গাব্দে মৌলভীবাজারের আদপাশা গ্রামে শ্রী চৈতন্যদেবের অন্যতম পরিষদের সেন শিবানন্দ বংশীয় নন্দকুমার সেন অধিকারীর কন্যা গুণময়ী দেবীকে বিয়ে করেন। পিতার রচিত গ্রন্থগুলো সে সময় তাঁর জন্য পিতা আদর্শ হয়ে হৃদয়ে স্থান করে নিলেন এবং কালক্রমে তিনি একজন স্বাভাবি কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
রচনা করেছেন তত্ব সংগীত,দেহতত্ব,ভক্তিমূলক,অনুরাগ,প্রেম,ভজন,বিরহ,ধামাইলসহ নানা ধরনের কয়েক হাজার গান। এবং লিখিছেন কয়েক শত ধামাইল গান। যার ফলে তাঁকে ধামাইল গানের জনক বলে আখ্যাহিত করা হয়। এসব ধামাইল গান দিয়ে নারীদের কন্ঠে গীত হত বিয়ের অনুষ্টানে। বিশেষ করে ধামাইল গান সিলেট,কাছার,ভারতের ত্রিপুরা ও ময়মসিংহ অঞ্চলে একসময় বেশী প্রচলিত ছিল। তিনি ছিলেন ধামাইল গানের জনক। রাধারমন দত্ত একাধারে গীতিকার,সুরকার,লোককবি ও শিল্পিও ছিলেন। তিনি মরমি কবি হাসন রাজার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক ছিল। তাঁদের মধ্যে অন্তরের মিল ছিল বেশি। তাঁদের বিভিন্ন সময় আলাপ আলোচনা হতো কবিতার মাধ্যামে। একদিন মরমি কবি হাসন রাজা রাধারমনকে কুশল জানাতে একটি পত্র লিখেন গানের চরণে “ রাধারমন তুমি কেমন,হাসন রাজা তোমায় দেখতে চায়” প্রতিউত্তরে রাধারমণ লিখেন “গানের সেরা রাহন রাজা,পেলাম না তার চরণ দর্শন,বিফলে দিন গেল গইয়া”। তাঁদের মধ্যে এভাবে পত্র আদান-প্রদান হত। রাধারমণ দত্ত একজন কৃষ্ণ প্রেমিক ছিলেন। তিনি কৃষ্ণ বিরহে অসংখ্য গান লিখে গিয়েছেন। এসব গানের মধ্যে বিখ্যাত গান হচ্ছে “ভ্রমর কইও গিয়ে শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে,অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে ভ্রমর কইও গিয়া”সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের জনক ছিলেন তিনি।
ব্যাক্তিজীবনে রাধারমণ দত্ত ছিলেন তিন ছেলে সন্তানের জনক। তাঁর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুত্রসহ স্ত্রী একযুগের মধ্যে মারা গেলে তিনি ভাবান্তর হয়ে যান। তাঁর মনে বৈরাগ্য ভাবের সৃষ্টি হয়। প্রথম পুত্র বিহারী দত্ত তখন মামার বাড়িতে মৌলভীবাজারের বেড়াতে যান এবং সেখানে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। বর্তমানে রাধারমণ দত্তের উত্তরসূরীসহ বংশধর সেখানে বসবাস করে যাচ্ছেন। রাধারমণ দত্তের সাধনা ছিল বৈষ্ণবরীতির,সঙ্গীত ছিল সাধনার অন্তরভূক্ত একটি বিষয়। দীর্ঘ ৩২ বছর ঈশ্বরের সাধনায় ছিলেন রাধারমণ। তিনি ৮২ বছর বয়সে ১৩২২ বঙ্গাব্দের ২৬ কার্তিক ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে শুক্রবার শুকাষষ্ঠি তিথিতে পরলোক গমন করেন। জন্মভূমি জগন্নাথপুর উপজেলার কেশবপুর গ্রামে তাঁর মরদেহ সমাহিত করা হয়। তারই শেষ স্মৃতি শ্মশান ঘাটটি বর্তমানে সমাধি ত্রে হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে। কেশবপুর গ্রামের নরসিং মালাকারের স্ত্রী নিদুমনি দাস রাধারমণ দত্তের সমাধিতে দীর্ঘ দুই যুগ ধরে সেবায়িতের ভূমিকায় কাজ করেছেন। আজ থেকে প্রায় ৭ বছর আগে নিদুমনি দাস মারা যান। বর্তমানে একই এলাকার রশু মালাকারের স্ত্রী অনিতা রাণী মালাকার রাধারমণ মন্দিরের দেখার কাজ করে যাচ্ছেন। কেশবপুর গ্রামের লন্ডন প্রবাসী এক ব্যাক্তির উদ্যেগে রাধারমণ দত্তের সমাধীস্থল পাকা করন করেন। এখন পর্যন্ত বিশ্বখ্যাত মরমি কবি রাধারমণ দত্তের সমাধীস্থল আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ভাবে সংরক্ষন করা হয়নি।
বৃহস্পতিবার (১০ নভেম্বর) রাধারমণ দত্তের ১০১তম মৃত্যু বার্ষিকী। এ উপলক্ষে সরকারীভাবে কোনো উদ্যোগ গ্রহন করা হয়নি। তবে স্থানীয় রাধারমণ দত্ত স্মৃতি সংসদের উদ্যেগে ১০১তম মৃত্যু বার্ষিকী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্টান অনুষ্টিত হবে। যদিও গত বছর সরকারীভাবে লোককবি রাধারমণ দত্তের শততম মৃত্যু বার্ষিকী দুদিন ব্যাপি জাকজমক ভাবে জন্মভূমি জগন্নাথপুর ও সুনামগঞ্জে উৎযাপিত হয়েছিল।
আলোচনা সভায় প্রধান অথিতির বক্তব্য রাখবেন বাংলাদেশ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম.এ মান্নান এমপি। আরো বক্তব্য রাখবেন সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম,প্রবীন রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব সিদ্দিক আহমদসহ স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন এবং রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
এছাড়া সংগীত পরিবেশন করবেন দেশের প্রত্যান্ত অঞ্চল থেকে আসা রাধারমণ ভক্তবৃন্ধ ও স্থানীয় বাউল শিল্পিগন।
স্থানীয়রা অনেকেই বলেন,শত বছর পার হয়ে গেলেও রাধারমণ দত্তের কোনো স্মৃতিস্মারন স্থাপিত হয়নি। তাই রাধারমণ দত্তের স্মৃতিস্মারন জন্মভূমিতে স্থাপন করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দাবী জানান।
উল্লেখ্য- গত বছর রাধারমণ স্মৃতি কমপ্লেক্সের জায়গা নির্ধারন করা হলেও আজ পর্যন্ত স্মৃতি কমপ্লেক্সের কাজের কোনো গতি দেখা যাচ্ছেনা।