শিক্ষা ও রাজনীতি; কওমি মাদ্রাসার টানাপোড়েন ও অনিশ্চয়তা

0
2088
blank
blank

আলতাফ পারভেজঃ

রাজধানীর জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় ঢুকেছিলাম মাগরিবের পরে। আলাপ শেষে এশার ওয়াক্ত হলো। জামায়াতে যোগ দিতেই অচেনা কিশোর তার জায়নামাজটা এগিয়ে দিল। মুগ্ধ হলাম। ফেরার সময় নাম জিজ্ঞাসা করতে মৃদু কণ্ঠে বলল, আবু বকর তামিম। দরিদ্র এই কিশোর বহুদূর থেকে পড়তে এসেছে।

সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের শিক্ষায় কওমি মাদ্রাসা অন্যতম আশ্রয়। তামিমের মতো ১৫ লাখের বেশি শিক্ষার্থী আছে কওমি মাদ্রাসাগুলোর তাহসির থেকে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণিতে। বছরে ২০-২২ হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক স্তর উত্তীর্ণ হয়ে বের হচ্ছেন। তার চেয়েও অনেক বেশি যুক্ত হচ্ছে প্রাথমিকে। বহুকাল কওমি মাদ্রাসা জাতীয় মনোজগতের বাইরে ছিল। এখন অতি দৃশ্যগোচর। বয়োজ্যেষ্ঠ আলেম-ওলামারা শিক্ষার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করছেন। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অনেকেই সাংসদ হতে আগ্রহী ছিলেন। তবে নির্বাচনের আগে-পরে জাতীয় দ্বিদলীয় ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ায় কওমি জগতেও ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। কওমি তরুণদের একাংশের সশস্ত্র তৎপরতার মাধ্যমে প্রভাব তৈরির চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। তারা এখন নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে নানাভাবে সচেষ্ট।

কওমি জগতে অনেক বিতর্ক ও ভিন্নমত

দু-তিন বছরের প্রবণতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, প্রায়ই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কওমি নেতারা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে যাচ্ছেন। যৌথভাবে অনেক বৈঠক, সভা-সমাবেশ-সংবর্ধনা হচ্ছে। ওয়াজ মাহফিলগুলোতেও ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের উপস্থিতি দৃশ্যমান। তবে রাষ্ট্র ও রাজনীতির সঙ্গে চলতি মেলামেশা, বোঝাপড়ায় কওমি জগতের ভেতরে তৈরি হয়েছে বিতর্ক, ভিন্নমত। এই মৈত্রী কতটা সুযোগ-সুবিধার প্রত্যাশায়, আর কতটা আত্মসমর্পণজাত সে নিয়ে জ্যেষ্ঠ কওমিয়ানদের মধ্যে মতভেদ আছে। এসব মতভিন্নতা থেকে দেখা দিচ্ছে উপদলীয় প্রতিযোগিতা, অবিশ্বাস। একক ভরকেন্দ্র ও নেতৃত্ব না থাকায় সংকট বাড়ছে। নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করতে অনেকে খুঁজছেন ইমান-আকিদা–সংক্রান্ত নতুন নতুন ইস্যু। তবে মাঠপর্যায়ে যেমন ‘গরম বক্তৃতা’ আছে, তেমনি ‘বোঝাপড়া’র সম্পর্কও জীবন্ত। সরকারও এখন আর আলেম-ওলামাদের সঙ্গে বসতে দ্বিধান্বিত নেই। সম্পর্কটা প্রসারিত হচ্ছে উভয়মুখী তাগিদে।

রাজনীতি ও প্রশাসনের প্রশ্রয় চাইছে কওমি

স্বাধীনতার পরও কওমি জগতে নেতৃত্বসংকট ছিল। সেই শূন্যতা পূরণ করেন হাফেজ্জী হুজুর এবং তাঁর পর আজিজুল হক ও ফজলুল হক আমিনী। সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী ও হাটহাজারীর একটা প্রভাবশালী ভূমিকা তৈরি হতে গিয়েও থমকে গেছে। আলাপচারিতার সময় জামিয়া রাহমানিয়ার মুহাদ্দিস মামুনুল হক বারবার অস্বীকার করছিলেন কওমির নেতৃত্বসংকটের কথা। তাঁর মতে, এ জগতে নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন অনেকে আছেন। হয়তো ‘ফোকাসে নেই’। ততটা ‘ক্যারিশম্যাটিক নন’—যতটা হলে একক কর্তৃত্ব তৈরি হয়। রাষ্ট্রীয় পরিসরে কওমি সংগঠকের একাংশের সাম্প্রতিক পুনঃপুন ওঠাবসাকে তিনি ‘অসচেতনতা, অতি উত্সাহ এবং নৈতিক বিচ্যুতি’ আকারে দেখতে চান। তাঁর ভাষায়, ‘শিক্ষাসংক্রান্ত স্বীকৃতিতে যতটা দরকার ছিল—তার বাইরের সম্পর্ক আমরা অনুমোদন করি না।’

তবে গত অর্ধযুগ কওমিকে সফলতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাষ্ট্র নিপুণতার পরিচয় দিয়েছে। কওমির একরোখা ভাব শান্ত হয়েছে। প্রশাসনের সঙ্গে সুবিধাগত হিস্যার একটা সম্পর্কও তৈরি হয়েছে। নানা উপদলে বিভক্ত নেতৃত্ব প্রায়ই নিজেদের বিবাদে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সালিস মানছে। কওমির অনেকে মনে করছেন, প্রশাসন ও রাজনীতির সহৃদয় প্রশ্রয়েই শুধু বিকাশ নির্বিঘ্ন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ‘সম্প্রীতি’র সাম্প্রতিক উপলক্ষ ছিল তাবলিগ জামাত প্রসঙ্গ। কওমির আপত্তি ও হস্তক্ষেপেই দিল্লি মারকাজপন্থীরা বাংলাদেশের জামাতে একক আধিপত্য হারিয়েছে। কওমির দাবি মেনে তাবলিগের ভাঙনকে পথ করে দেওয়া হয়েছে। মাওলানা মামুনুল হক মনে করেন, তাবলিগের কাজে তাঁদের হস্তক্ষেপ প্রয়োজনীয় ছিল। দেওবন্দের নির্দেশ মেনেই এটা হয়েছে। এই বিভক্তিকে ‘দুঃখজনক’ বলে এ–ও তিনি স্বীকার করেন, তাবলিগের বিবাদে কওমি নেতারা সচেতনভাবেই প্রশাসনের মধ্যস্থতা কামনা করেছেন।

কওমির সঙ্গে রাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সম্পর্ককে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আলী রীয়াজ দেওবন্দ ঐতিহ্যের ব্যত্যয় হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, দেওবন্দ শিক্ষা আন্দোলনের সূচনা রাষ্ট্রীয় সুবিধা চেতনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে। রাজনৈতিক প্রশাসন থেকে দূরে থাকতেই অভ্যস্ত এই শিক্ষাধারা। কিন্তু বাংলাদেশে কওমির সঙ্গে রাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সম্পর্ক যতটা শিক্ষা প্রশ্নে—তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক প্রশ্নে। কেউ এটা ইতিবাচক, কেউ নেতিবাচক হিসেবে দেখতে পারে। হয়তো কওমি অস্তিত্বের জন্য আপস করছে। রাষ্ট্রও তাদের প্রয়োজনীয় মনে করছে। এই সম্পর্ক স্বল্পমেয়াদি পারস্পরিক সুবিধার লক্ষ্যেই মনে হচ্ছে। ‘উম্মাহ ২৪ ’-এর সম্পাদক মাওলানা মুনির আহমদ মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারণ প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশ। মাদ্রাসা শিক্ষাক্রম নির্বিঘ্ন রাখতে অনেকেই রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় আছেন।

বৃহত্তর ইসলামি ঐক্যের বাস্তবতা নেই

কওমির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের চলতি আস্থা-বিশ্বাস-নির্ভরতার গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান জামায়াতে ইসলামীকে দৃশ্যপট থেকে দূরে রাখায় ঐকমত্য। কওমির এক অংশ বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের বিপর্যয়ে স্বস্তিতে আছে। ‘এতে জামায়াতকে কোণঠাসা রাখা যাচ্ছে।’ বিএনপি ক্ষমতায় এলে জামায়াত যে ‘সুবিধা’ ভোগ করত, কওমির একাংশ নিজেদের জন্য তদ্রূপ চলমান সুবিধা আরও দীর্ঘদিন দেখতে ইচ্ছুক। এরূপ মনোভাব পোষণকারীদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদবিরোধী ধারার সহসা ঐক্যের সম্ভাবনা নেই।

আকারে বিশাল হলেও কওমি ঘরানায় পরিবর্তনবাদী রাজনৈতিক তরুণের সংখ্যা বেশি নয়। তাঁরা এটা স্বীকার করেন, মাদ্রাসার বাইরে
জনসমাজে আলেমদের রাজনৈতিক আবেদন তৈরি না হওয়া একটা রূঢ় বাস্তবতা। মাওলানা মামুনুল হক এটাকে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ঔপনিবেশিক ধরনের সফলতা হিসেবে দেখতে ইচ্ছুক। তাঁর ভাষায়, ‘কওমিরা ইমান-আকিদা রক্ষার কাজ শেষে এখনো রাষ্ট্রব্যবস্থার ঔপনিবেশিক চ্যালেঞ্জকে বিবেচনায় নিতে পারেনি।’ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম জামায়াতে ইসলামী। আর জামায়াত সংগঠকদের বিবেচনায়, ‘জনজীবনের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে কওমি আলেমরা সমর্থ নন।’

মাদ্রাসার পর মাদ্রাসা ঘুরে মনে হয়েছে, মওদুদীর ঐতিহ্যধারী জামায়াতের সঙ্গে কওমির আদর্শিক দূরত্ব প্রায় অনতিক্রম্য। এই দুয়ের যৌথ কাফেলার অবকাশ কম। ব্যক্তিগত পর্যায়ে শিবির কর্মীদের প্রতি সহানুভূতির ঘাটতি নেই কওমি তরুণদের; কিন্তু ওদের মূল দলের সাম্প্রতিক ভাঙন–প্রক্রিয়াকে উত্সাহের সঙ্গেই দেখা হচ্ছে। মামুনুল হক মনে করেন, জামায়াতের একাংশ যদি মওদুদীর পথ ছেড়ে নিজেদের পুনর্বিন্যাস করে, তাহলেই শুধু কওমির সঙ্গে মৈত্রী হতে পারে। শিগগির সে রকম লক্ষণ নেই।

শক্তি পরীক্ষা চলেছে বিভিন্ন ইস্যুতে

কওমির শক্তি ও সংকট উভয়ই মাদ্রাসা। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা কর্তৃপক্ষের কঠোর নিয়ন্ত্রণে থাকে। আবার এক মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ অন্য মাদ্রাসার খবরদারিত্ব মানতে এখন আর রাজি নয়। লালবাগ মাদ্রাসার প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং ‘ফাতেহ-২৪’ ইসলামি অনলাইন সংবাদপত্রের তরুণ সম্পাদক ইফতেখার জামিল বলেন, ‘আর্থিক ও পরিচালনাগত স্বাবলম্বিতা আসছে প্রধান প্রধান মাদ্রাসায়। কেউ একক ভরকেন্দ্রের পক্ষে নেই আর।’ এই মনোভাবের ছাপ পড়ছে কেন্দ্র ছাড়িয়ে প্রান্তেও।

গ্রামে-গঞ্জে সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমরা রাষ্ট্র তাঁদের ভাষায় ‘ইসলামবিরোধী’ অবস্থান না নিলেই সন্তুষ্ট। মূলধারার রাজনীতির বিরুদ্ধে বাড়তি আক্রমণাত্মক অবস্থানের প্রতিও তাঁদের সমর্থন নেই। ২০১৩ সালের অভিজ্ঞতা থেকে অধিকাংশই সহিংসতার চেয়ে সংলাপেরই পক্ষপাতী। তাঁরা আন্তর্জাতিক পরিবেশও বিবেচনায় রাখছেন। ফলে কওমি জগতে রাষ্ট্রসম্পৃক্ত ধারাই শক্ত অবস্থানে থাকছে আরও অনেক দিন। আবার সব ধারাই সাংগঠনিক সামর্থ্য ধরে রাখতে তাবলিগ, কাদিয়ানি ইত্যাদি ইস্যুতে শক্তি পরীক্ষা করে চলেছে। পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন স্থানে সর্বশেষ উত্তেজক সমাবেশগুলো শক্তি প্রদর্শনের পাশাপাশি নেতাদের রাজনৈতিক বৈধতা ধরে রাখার চেষ্টাও বটে। এটা রাষ্ট্র জানে। টিকে থাকার সংগ্রামে নেতৃত্বের এসব কৌশল জাতীয় রাজনীতির ভারসাম্যহীনতারই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এ শক্তির রাজনৈতিক ভাগ্যও নির্ধারণ করে দেবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভবিষ্যৎ পরিণতি।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক

সূত্র: প্রথম আলো।